অভিরূপ দাস: দুটো মৃত্যু আর একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। মাথায় আর চুল রাখবেন না বছর একুশের তরুণী। তাঁর বয়সে আর সবাই যখন চুলের বাহারি কেতা নিয়ে ব্যস্ত, সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলে ফেললেন টালিগঞ্জের সৌমিতা ভট্টাচার্য। সাইড সোয়েপ্ট, লেয়ারস কাট নয়, একেবারে নেড়া হয়ে গেলেন কর্কট-আক্রান্তদের জন্য।
‘এক মাথা চুল কোথায় গেল রে?’ পুজোর ছুটির পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হতে এমনটাই প্রশ্ন করেছিল তারা। আড়ালে কেউ মুচকি হেসে টিপ্পনি কেটেছিল। অবশ্য তাতে দমে যাননি টালিগঞ্জের বাসিন্দা। নেড়া মাথায় এখন সামান্য চুল গজিয়েছে। কদমছাঁট নিয়েই দিব্যি খুশি সৌমিতা। জানিয়েছেন, ফের চুল বড় করে ক্যানসার রোগীদের দান করবেন তিনি।
এমন সাহসী সিদ্ধান্তের কারণ? নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অনার্সের ছাত্রীর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে দুটো মৃত্যু। একজন তাঁর ছোটবেলার শিক্ষক। ছোটবেলা থেকেই যার ন্যাওটা ছিলেন সৌমিতা। আচমকাই ফুসফুসের ক্যানসারে হারিয়ে ফেলেন তাঁকে। সৌমিতার কথায়, ‘ক্যানসার আমার দুই প্রিয়জনকে ছিনিয়ে নিয়েছে। একজন আমার গৃহশিক্ষক। অন্যজন ঠাকুরমা।’ গলব্লাডারের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন সৌমিতার ঠাকুরমা। অসুখের চেয়েও কঠিন ছিল বাস্তবটাকে মেনে নেওয়া। লড়াইয়ের সেসব দিনের কথা বলতে গিয়ে গলা বুজে আসে সৌমিতার। ‘ঠাকুরমার মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকত। কোমর সমান চুল। কিন্তু, কেমো শুরু হতেই তা পড়ে যেতে শুরু করে। তাতে একটা হীনমন্যতায় ভুগতেন উনি।’ ঠাকুরমার চিকিৎসা চলার সময়ই একাধিক ক্যানসার হাসপাতালে ঘুরেছেন সৌমিতা। সেখানেই দেখেছেন কেমো চলাকালীন ক্যানসার আক্রান্তদের মাথার চুল পড়ে যাওয়ার ছবি। অনেক মানুষ তাঁদের নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করেন। অবাক চোখে তাকান। অসুস্থতার সঙ্গে যুঝতে গিয়ে এই ধরনের মন্তব্য, চাহনি তাদের উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
ঠাকুরমা চলে যাওয়ার পরে নিজের চুল বাড়াতে শুরু করেন সৌমিতা। বন্ধুরা ভেবেছিল হয়তো নতুন কোনও কায়দা দেখা যাবে। তারপর আচমকাই একদিন দেখা যায় মাথা জুড়ে চকচকে টাক। সৌমিতা জানিয়েছেন, ‘মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম। আমি নিজে মুম্বইয়ের একটি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করি। ক্যানসার রোগীদের নিয়েই কাজ করে তারা।’ মুম্বইয়ের সেই সংস্থার মাধ্যমেই জানতে পারেন ক্যানসার আক্রান্তদের চুলের বড্ড প্রয়োজন। কেউ চুল দান করলে তা দিয়ে ক্যানসার রোগীদের পরচুলা তৈরি হতে পারে। ব্যস, আর দেরি করেননি টালিগঞ্জের সিরিটির বাসিন্দা। শুনেছেন দেশজুড়ে ছ’হাজার লোক এমন মহৎ কাজে শামিল হয়েছেন। সৌমিতার কথায়, ‘অনেকেই চুল ঠাকুরের মন্দিরে দান করে। আমার মনে হয় মুমূর্ষু এই মানুষগুলোর উপরে ঠাকুরের আশীর্বাদ আছে। তাই তো এই লড়াইটা তাঁরা লড়তে পারছেন। আমার আজীবনের চুল তাই কর্কটাসুরকে হারানোর লড়াইয়ের জন্যেই বরাদ্দ।’
সৌমিতার এ গল্প শুনেছেন অনেক চিকিৎসকও। ক্যানসারের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গবেষক ডা. মধুছন্দা কর জানিয়েছেন, সৌমিতার এই গল্প নতুন প্রজন্মের অনেককে উদ্বুদ্ধ করুক। দামি সেলুনে গিয়ে চুল কাটতে যে টাকা খরচ হয় তার চেয়ে অনেক দামি সৌমিতার এ কাজের স্বীকৃতি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.