ছবি: প্রতীকী।
অর্ণব আইচ: উত্তর কলকাতার জয়মিত্র স্ট্রিটের ফ্ল্যাটটির বাসিন্দা সহজে খুলছিলই না দরজা। ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসছিল একটি শিশুর কান্না। তাই লালবাজারের গোয়েন্দারা আর কোনও ঝুঁকিই নেননি। দরজার লক ভেঙে তাঁরা ভিতরে ঢুকে দেখেন, আতঙ্কে চিৎকার করে কাঁছে একটি তিন বছরের শিশুকন্যা। আর ঘরের এক কোনায় বসে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে ১৪ বছরের এক কিশোরী। সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকে কোলে তুলে নেন এক মহিলা পুলিশকর্মী। অন্য মহিলা পুলিশকর্মী ও অফিসাররা তখন ওই কিশোরীকে বোঝাতে ব্যস্ত যে তার কোনও ভাবনা নেই। তার পাশে এখন আছেন কলকাতা পুলিশের ‘আন্টি’রা। এর মধ্যে দরজা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল ২৪ বছর বয়সের যুবকটি। যদিও তার আগেই ঋতুরাজ সিং নামে ওই যুবকটিকে ধরে ফেলেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। উদ্ধার হওয়া ওই শিশু ও কিশোরীটিকে হোমে রাখা রয়েছে। পাশাপাশি এই চক্রের মূল পাণ্ডা ও ধৃতের বাবা-মার সন্ধানে তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ।
ভিনরাজ্য থেকে গরু-ছাগলের মতো বাছাই করে দুধের শিশুকন্যাদের কিনে কলকাতায় নিয়ে আসা। কয়েক বছর ধরে লালনপালন করার পর একটু বড় হলেই তাদের যৌন ব্যবসায় ঠেলে দেওয়া। যখন তাদের কারও বয়স ১২ আবার কারও বয়স ১৪, তখনই তাদের বয়সে কয়েক গুণ বড় পুরুষের লালসার শিকার হতে হয়। উত্তর কলকাতার বড়তলা থানা এলাকার জয়মিত্র স্ট্রিটে ধরে অত্যন্ত গোপনে চলছিল এই শিশুকন্যা পাচার চক্র। তার মূলে রয়েছে এক দম্পতি সুনীল সিং ও সুরেখা সিং। এতটাই গোপনে এই চক্রটি চলছিল যে শহরের যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে যে সংগঠনটি, তার সদস্যরাও কোনও কিছু জানতে পারেননি। জানতে পারেনি পুলিশও। এই দম্পতির কাছে বেড়ে ওঠা ও বহু পুরুষের লালসার শিকার হওয়া এক তরুণীই কোনওমতে ওই বাড়িটি থেকে পালিয়ে এসে পুলিশকে জানান ওই তথ্য।
জানান, তিন বছরের ওই দুধের শিশু ও এক কিশোরীকে মোটা টাকা দিয়ে কিনে ঘরে রেখে দিয়েছে তারা। ওই কিশোরীকে তারা যৌন ব্যবসায় নামানোর ছক কষছে। তিন বছরের শিশুটিকে হয়তো এই কারবারে নামানো হত আর কয়েক বছর পরই। ছেলে ঋতুরাজকে পাহারায় রেখে দম্পতি বাইরে গিয়েছে আরও শিশুকন্যা কেনার সন্ধানে। তারপরই এই চক্রের সন্ধানে চলে তল্লাশি।
পুলিশ জানিয়েছে, কিছুদিন আগেই ২২ বছরের ওই তরুণী চক্রের মাথা ওই দম্পতি ও তাদের ছেলের চোখ এড়িয়ে পালিয়ে যায় অনেকটাই দূরে। ক্রমাগত কাঁদতে থাকা ওই তরুণীটিকে উদ্ধার করে বড়তলা থানার পুলিশ। তাঁকে ঠাকুরপুকুরের হোমে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের আধিকারিকরা জিজ্ঞাসাবাদ করতেই রহস্যের জট খোলে। ওই যুবতী গোয়েন্দা পুলিশকে জানান, তিনি আগ্রার ধানকোটের বাসিন্দা। অভিযুক্তদেরও আসল বাড়ি একই এলাকায়। মেয়েকে ভাল করে রেখে কাজ করানোর নাম করে মা-বাবার কাছ থেকে ওই চক্রটি তাকে কিনে নেয়। ওই তরুণীর বয়স যখন সাত বছর, তখনই তাঁকে মোটা টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া হয়েছিল। এরপর টানা সাত বছর ধরে তাঁকে লালনপালনও করা হয়। এসময় বিভিন্ন ধরনের হরমোনের ওষুধ খাওয়ানো হত তাঁকে। ১৪ বছর বয়স হলেই তাঁকে জোর করে যৌনকর্মে নামানো হয়। তিনি বাধা দিলে তাঁকে মারধরও করা হয়েছিল। টানা আট বছর ধরে প্রায় প্রত্যেক রাতে তাঁকে কোনও না কোনও পুরুষের লালসার শিকার হতে হয়েছে। অনেকদিন ধরে থাকার ফলে তাঁর উপর ভরসা এসে গিয়েছিল ওই দম্পতির। সেই সুযোগেই পালিয়ে যান ওই যুবতী। তারপর পুলিশের দ্বারস্থ হন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.