দীপালি সেন: ব্যক্তিমানুষের যৌনসত্তা নিয়ে দীর্ঘকালের সংস্কার, সংকোচ, সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়া যে কিছুটা হলেও শিথিল হচ্ছে, তার ইঙ্গিত মিলল চলতি বছরের একাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের রেজিস্ট্রেশনের চিত্রে। এ বছরই প্রথমবার একাদশ শ্রেণির রেজিস্ট্রেশনের (Registration) ফর্মে লিঙ্গ পরিচয়ে দেওয়া হয়েছে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’-র (Third Gender) অপশন। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ সূত্রের খবর, সেই অপশন নির্বাচনের মাধ্যমে স্ব-পরিচয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছেন পাঁচ শতাধিক পড়ুয়া।
চলতি বছর একাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের রেজিস্ট্রেশন হয়েছে সম্পূর্ণ অনলাইনে (Online)। এই প্রথমবার তা অনলাইনে হল। এবং তাতে লিঙ্গ পরিচয়ের কলামে মহিলা, পুরুষের সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের অপশন দেওয়া হয়েছে। কলা, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান – তিনটি শাখাতেই পুরুষ বা মহিলা না লিখে না নিয়ে স্ব-পরিচয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছেন পাঁচশোর বেশি পড়ুয়া। বিজ্ঞান ও বাণিজ্যে তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে রেজিস্ট্রেশন করা পড়ুয়া একশোর কম হলেও কলা শাখায় সংখ্যাটা চারশোর দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছে।
রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে বহুদিন আগেই। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভরতির ফর্মে ‘অন্যান্য’ অপশনের মাধ্যমে তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয় জানানোর সুযোগ থাকে। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের (WBHSC) উদ্যোগে স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথমবার স্বীকৃতি পেলেন তৃতীয় লিঙ্গের পড়ুয়ারা। এ প্রসঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘তৃতীয় লিঙ্গকে আইনত স্বীকৃতি দেওয়া হয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও মেলে স্বীকৃতি। স্কুলশিক্ষাতেও সেই স্বীকৃতি দিতে একাদশ শ্রেণির অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের পোর্টাল তৈরির সময়ই লিঙ্গ পরিচয়ে পুরুষ, মহিলার সঙ্গে ‘অন্যান্য’ তথা তৃতীয় লিঙ্গের সংযোজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এর মাধ্যমে আমরা একটা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছি বলে মনে করছি।’’ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের এই পদক্ষেপ এবং তাতে পড়ুয়াদের সাড়া দেওয়া – দু’টিকেই ‘বৈপ্লবিক’ বলে আখ্যা দিচ্ছে রাজ্যের শিক্ষা মহলের একটা বড় অংশ। সাধুবাদ জানাচ্ছেন শিক্ষাবিদরা।
পুরাণ বিশেষজ্ঞ তথা শিক্ষাবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর কথায়, ‘‘তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে ফর্মপূরণ করতে বলা হচ্ছে এবং তাঁরা করছেন, এটা একটা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জায়গা। আগে লুকিয়ে করতে হত বা চেপে রাখতে হত। এই পদক্ষেপে একটা মুক্তির জায়গা তৈরি হল। সরকারের, বিশেষ করে বাংলার সরকারের দিক থেকে এই স্বীকৃতিটা আসছে, তাতে আমি খুব খুশি এবং গর্বিতবোধ করছি।’’ এই উদ্যোগে সাড়া দিয়ে তৃতীয় লিঙ্গের পড়ুয়াদের এগিয়ে আসাকেও বাহবা জানাচ্ছেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী। বলেন, ‘‘এতকাল ওদের বলার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ ছিল না। রাষ্ট্রের দিক সেই অপশনটা এল, এটা বেশি মহৎ। সেই উদ্যোগে সাড়া দিয়ে পাঁচ শতাধিক পড়ুয়া এসে বলল, ‘আই অ্যাম আ ট্রান্সজেন্ডার এবং আমার এটা বলতে কোনও লজ্জা নেই’ – সেটা আরও বেশি ভাললাগার জায়গা। ওঁরা বিদ্যাস্থানে নিজের পরিচয়ে, স্বনামে প্রবেশ করতে পারছেন, সেটা সব থেকে বড় কথা। বিদ্যালাভের পর ওরা চাকরির জগতেও প্রবেশ করবে। প্রমাণ করে দেবে ‘নট দিস, নট দ্যাট’ আমরাও কিছু কম যাই না।’’
রাজ্য সিলেবাস কমিটির (Syllabus Committee) চেয়ারম্যান অভীক মজুমদার বলেন, ‘‘আমাদের সামাজিক ইতিহাসের দিকে তাকালে এটা একটা বিরাট বড় পদক্ষেপ। যে কোনও ধরনের প্রান্তিক বা অবহেলিত গোষ্ঠীর যদি কেন্দ্রীয় স্বীকৃতির জায়গা তৈরি হয়, সেটাকে অভিনন্দন জানাতেই হবে। এই ধরনের অভিমুখ ভারতবর্ষের আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। ফলে, এটা একটা দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ। আগামী দিনে আরও নানা প্রান্তিক ক্ষেত্র ও বর্গগুলিকে কেন্দ্রে নিয়ে আসার প্রয়াস জারি রাখতে হবে। যাতে শিক্ষার ক্ষেত্রে এক ধরনের সমতা তৈরি হয়। শিক্ষায় মেধা ছাড়া, অন্য কোনও ক্ষেত্রই প্রাধান্য পাবে না। এটাই দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত। এই পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমি উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.