স্টাফ রিপোর্টার: কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে এল। নিউটাউন জমি কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে পুলিশ ও গোয়েন্দারা হিডকো এবং এনকেডিএ আরও বিপুল জমি বেআইনিভাবে লেনদেনের একাধিক অভিযোগ হাতে পেলেন। বিশেষ করে এক সদ্যনির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যর নেতৃত্বে সরকারি জমি দখল করে রেস্তরাঁ বানানো এবং একটি নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তনীদের কো অপারেটিভ আবাসনের প্লট নিয়েও অভিযোগ পেয়েছেন গোয়েন্দারা। শুধু তাই নয়, হিডকোর বেশ কিছু অবসরপ্রাপ্ত কর্মী এবং অফিসারও এই জমি প্রতারণা চক্রের অন্যতম মাথা বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। অবশ্য নিউটাউনে জমি কেলেঙ্কারির জেরে শতাধিক কোটি টাকা হারানো ক্রেতারা গত সপ্তাহে ছয়টি এফআইআর করেন টেকনো সিটি থানায়।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ তিন প্রতারকের সন্ধান পেয়েছে। কিন্তু তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারছে, শুধু তিনজনই নয়, সরকারি জমি কেলেঙ্কারির পিছনে আরও অনেক মাথা রয়েছে, সেই সমস্ত রাঘব-বোয়ালদের খোঁজে জোর তল্লাশি শুরু করেছে বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দা বিভাগ। অভিযোগ নিয়ে ইতিমধ্যে বিভাগীয় তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। আবেদন করেছেন, সরকারি অফিস থেকেই জমি কিনতে। টেন্ডার ও মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ছাড়া জমি বিক্রি করে না হিডকো।
নকল ভুয়ো নথি দিয়ে কয়েক একর জমি বিক্রির নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করতে কেষ্টপুরে যে বেসরকারি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল, তার অ্যাকাউন্ট হোল্ডার কারা, সেই তথ্য জানতে নথি সংগ্রহ করছেন গোয়েন্দারা। ব্যাংকের একাধিক আধিকারিককে ও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করবে বলে সূত্রের খবর। জমি রেজিস্ট্রি করার সময় ক্রেতাদের কাছ থেকে সেখানেই হয়েছিল টাকা জমা! অ্যাকাউন্ট মারফত কেলেঙ্কারির বিপুল অঙ্কের টাকা কোথায় বা পাঠানো হয়েছিল! তার সন্ধানেও তৎপর হয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। কমিশনারেট গোয়েন্দাদের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্তা শুক্রবার জানিয়েছেন, জালিয়াতি চক্রের জাল গুটিয়ে আনতে তদন্তে এতটাই গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়েছে যে, হদিশ পাওয়া তিনজনের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আশা করা হচ্ছে খুব দ্রুততার সঙ্গে গোটা তদন্ত প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটবে।
দিনকয়েক আগেই নিউটাউনে বড়সড় একটি জমি কেলেঙ্কারির খবর নবান্নের কাছে এসেছে। তবে গোটা কেলেঙ্কারির সঙ্গে হিডকোর শীর্ষ পর্যায়ের কোনও আধিকারিকের যোগসূত্র পায়নি পুলিশ। অভিযোগ, সেখানে অসাধু কারবারিরা হিডকোর মূল্যবান জমির ভুয়া নথি বানিয়ে তা অন্যজনকে বিক্রি করছিলেন। সেই চক্রের খপ্পরে পড়ে অনেকেই প্রাইম লোকেশনের জমি কিনেছেন। পরে জমির মিউটেশন করতে গিয়ে বুঝেছেন প্রতারিত হতে হয়েছে। চক্রের ফাঁদে পড়ে গত সপ্তাহে টেকনো সিটি থানার দ্বারস্থ হন প্রতারিত ক্রেতারা। ঘটনার বিশদ জানিয়ে সেখানে লিখিতভাবে অভিযোগ দায়ের হয়।
কমিশনারেট পুলিশ সূত্রে খবর, নিউটাউনের জমি কেলেঙ্কারির খবর চাউর হতেই জানা যাচ্ছে, তাতে অনেকেই প্রতারিত হয়েছেন। জমি কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারছে, এলাকার কিছু অসাধু মানুষের সাহায্য নিয়ে প্রতারকরা কলকাতার বাইরে বসে নিউটাউনে জমির ভুয়ো নথি তৈরির কাজ চালাত। গোটা চক্রে বাম জমানায় হিডকো দফতরে চাকরি করা একাধিক অবসরপ্রাপ্ত মাথা রয়েছে। তাদের নাম ও পরিচয় গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে।
নিউটাউনে জমি কেলেঙ্কারির জাল এখানেই শেষ হচ্ছে, এমনটা নয়। হিডকোর আওতাভুক্ত একাধিক জমি স্থানীয় কয়েকজন দাপুটে লোকজন কবজা করছে বলে খবর মিলছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, নিউটাউন থানাকে ডানহাতে রেখে খানিকটা এগোলেই ইউনিটেক বিল্ডিং। এই তথ্যপ্রযুক্তি ভবন ফেলে রেখে পাঁচশো মিটারের মতো পথ সাপুরজির দিকে গেলেই মূল রাস্তার পাশে স্থানীয় এক ‘নেতা’র বিরুদ্ধে হিডকোর জমির উপর জোর করে রেস্তরাঁ গড়ে তোলার অভিযোগ উঠছে৷ মাস তিনেক আগে কেষ্টপুর বাগজোলা খালপাড় লাগোয়া বালিগড়িতে একটি সমবায় আবাসন গড়ে তোলার পিছনে হিডকোর জমি কেলেঙ্কারির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, বালিগড়ি, চকপাঁচুড়িয়া ইত্যাদি এলাকার হিডকো অধিগৃহীত কিছু জমি স্বল্পমূল্যে অর্থাৎ ৭-৮ লক্ষ টাকা কাঠায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতে ইউনিটেক-২ বিল্ডিংয়ের সামনে রাতারাতি হিডকোর জমিতে অস্থায়ী পার্টি অফিস গজিয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। দিনের পর দিন কোন জাদুবলে নিউটাউনের বুকে জমি দখলদারি চলছে তা বুঝে উঠতে পারছেন না স্থানীয়রা। অনেকেই আবার নিউটাউন শহর কর্তৃপক্ষ হিডকো ও এনকেডিএ’র আধিকারিকদের একাংশের মদতের অভিযোগও তুলছেন। পুলিশ বলছে, সবেমাত্র জমি কেলেঙ্কারির খবর সামনে এসেছে। তদন্তে সবটাই খতিয়ে দেখা হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.