রমেন দাস: সেদিন সকালেও ঘুম ভেঙেছিল কাকভোরে। ভরা ফসলের মরশুমে বাজারে যাওয়ার তাড়া ছিল সরবালা মিনজির! কিন্তু নিজের পায়ে হেঁটে সেই তাঁর শেষ যাওয়া। তারপর এক মুহূর্তেই রক্তাক্ত জীবন দেখেছেন বছর ৪০ এর মহিলা। পারেননি আর। ট্রাকের ধাক্কায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়েছে ওঁর জীবন!
‘এখানে বৃষ্টি পড়ে বারোমাস’। এ যেন কান্নার বৃষ্টি! কামনা-বাসনার পাহাড়ে জমে ধুলোও। তবুও ওঁরা ছোটেন। সরবালারা ছুটে চলার আশায় দূরদূরান্ত থেকে হাজির হন ওঁদের কাছে! যাঁদের এই সমাজ বলে ‘বিশেষভাবে সক্ষম’। কেউ কেউ কটাক্ষের সুরেই ঠেলে দেয় ‘প্রতিবন্ধী’ (Specially abled) তকমার দিকে। তাঁদের নিয়েই স্বপ্ন দেখেন সমাজের বিশেষরাই। আর সেই স্বপ্ন-সুখের এক ‘কারখানা’ তৈরি হয়েছে কলকাতার (Kolkata) ইকবালপুর মোড়ের মহাবীর সেবা সদনে।
১৯৮৫ সালে তৈরি হওয়া এই প্রতিষ্ঠানেই নিরন্তর তৈরি হয় ‘নকল’ হাত, পা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘প্রস্থেটিক্স’ (Prosthetic)। যা হাত, পা হারানো মানুষের জন্য তৈরি হয়। পেশির দুর্বলতা অথবা শারীরিক নানা কারণে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়ে ফেলাদের জন্যই এই সুবিধা।
কিন্তু এখানেই রয়েছে অন্য বিশেষত্ব। মহাবীর সেবা সদনের এই হাত, পায়ের ‘কারখানা’য় যাঁরা কাজ করেন, অর্থাৎ ‘প্রস্থেটিক্স’ তৈরির কারিগররা প্রায় প্রত্যেকেই বিশেষভাবে সক্ষম। অর্থাৎ যাঁরা অন্যের চলনের জন্য পা, হাত তৈরি করছেন, তাঁদের অধিকাংশই বিভিন্ন কারণে হারিয়েছেন হাত অথবা পা! অর্থাৎ কৃত্রিম অঙ্গ নিয়েই ওঁরা তৈরি করেন অন্যের অঙ্গ!
কিন্তু কেন এই উদ্যোগ? মহাবীর সেবা সদনের কর্মী স্বপন আচার্যর কথায়, ”একজন প্রতিবন্ধীই বোঝেন আর একজন প্রতিবন্ধীর জ্বালা। এই কষ্টের ভার ঠিক কতটা, তাঁরাই উপলব্ধি করতে পারেন। আসলে মহাবীর সেবা সদনের লক্ষ্য স্বনির্ভর করে তোলা। ভিক্ষা কেন করবেন ওঁরা, নিজেরা কাজ শিখে উপার্জন করবেন, এটাই ভাবা হয়।” স্বপনের কথায়, ”জয়পুরে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার মাধ্যমে ওঁরা প্রস্থেটিক্স তৈরি শেখেন। যা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দান করা হয় সাধারণ অসহায় মানুষকে।”
এই দলেই রয়েছেন ত্রিদীপ্ত দাস। প্রত্যন্ত জেলার ছেলে প্রায় ১০ বছর ধরে এই কাজ করছেন। পোলিও রোগে অকালে হারিয়েছেন ডান পা। তাঁর কথায়, ”আমি সব কাজ পারি। নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে কাজ হয়। নিজের পা নেই। প্রস্থেটিক্স পরেই কাজ করি। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে।” প্রায় একই সুর প্রবীর মণ্ডলের গলায়। তাঁর কথায়, ”মহাবীর সেবা সদন আমাদেরও বাঁচার অধিকার দিয়েছে। আমরা নিজেদের জন্য কাজ করতে পারি। যতই কষ্ট থাকুক। খানিকটা তো ভালো এর মাধ্যমেও থাকা যায়।”
আপ্পুকুমার যাদব নিজেই রোগী। হারানো পায়ের খোঁজে এখানে এসেছিলেন তিনি। তারপর আর নিরাশ হতে হয়নি। তিনিও হয়ে উঠেছেন ‘প্রস্থেটিক্স’ কারিগর। আপ্পু বলছেন, ”এখানে কাজ করেই সংসার চলে। ভিক্ষা করে খাব কেন, অনেকেই বলেছেন পা নেই কী করে বাঁচব! কিন্তু পেরেছি আমরাও।”
রামপদ, সুরজিৎ, শ্যামরা এই কারখানার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে দিচ্ছেন আগুন। প্রত্যেক মুহূর্তে গড়ে তুলছেন অন্যের ভালো থাকার রসদ। এমনই এক গ্রহীতা মধুসূদন দত্ত। আচমকা ডায়াবেটিসে কাটা গিয়েছে পা! অকালে সব হারিয়েছেন তিনিও। কিন্তু মধুসূদনের মনের জোর কমেনি আজও। তিনি বলছেন, ”আসল পা হারিয়েছে। কিন্তু এই নকল পা কম কীসের! কিছু তো করে খেতে পারব! ভয় না পেয়ে এগিয়ে যেতে চাই।”
ভয়কে জয় করে এগোচ্ছেন ওঁরাও। ঝা চকচকে বাড়ির এক কোণের ঘরেই মুঠো মুঠো রোদ্দুর ছড়িয়ে দিচ্ছেন কিছু সূর্য। আনন্দমোহন তিওয়ারি, চিকিৎসক প্রভাকরদের নির্দেশে এক অসীম সুখের স্বর্গ গড়ছেন বিশেষভাবে সক্ষমরাই।
কিন্তু এই হাত, পায়ের কারখানার পরিচিতিতে বিরাট অবদান রয়েছে বালির বাসিন্দা এক সমাজকর্মীর। প্রিয়রঞ্জন সরকারের কথায়, ”একবার বাঁকুড়া থেকে ফেরার সময় এক বিশেষভাবে সক্ষমকে সাহায্য করতে গিয়ে অবাক হই। তিনি পা লাগিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। তারপর খোঁজ করে জানতে পারি মহাবীর সেবা সদনের কথা। যোগাযোগ করি এখানে। এরপর বহু মানুষকে চলতে সাহায্য করেছি। আগামী দিনে জেলায় জেলায় যাব। মোবাইল আম্বুল্যান্সের মাধ্যমে কাজ চলবে।”
তিলোত্তমার কোলাহল ভরা রাস্তাতেও এ যেন শান্তির ডাক! চিকিৎসা, বিজ্ঞানের ইতিহাস ছাড়িয়ে এক মানবতার গানও। মহামানবদের জীবনযুদ্ধে পথ দেখানোর তাগিদ। আর সেই তাগিদে ভর করেই এগিয়ে চলা সকলের, এমনও বলছেন কেউ কেউ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.