সরোজ দরবার: ‘আমাদের ক্লাবের ঠাকুর ছিল একেবারে সাবেকি স্টাইলের। শংকরদা বলত যে ওই চালচিত্তির, ডাকের সাজ…তারপর ড্যাবড্যাবে চোখ না হলে ঠিক ভক্তি আসে না’- বলেছিলেন সত্যজিতের ‘নায়ক’ অরিন্দম। এ তো শুধু তার একার কথা নয়। বরং আম-বাঙালির মনের কথা। হাজারো থিমের ঘনঘটাতেও আজও যেন ওই ঢলঢলে চোখের প্রতিমাতেই বাঁধা পড়ে থাকে বাঙালির দুর্গাপুজো। বদলে যাওয়া কলকাতার পুজোর চালচিত্রে সেই সাবেকিয়ানার অদ্বিতীয় ঠিকানা বাগবাজার সার্বজনীন। আর যাঁর হাতে গড়া হত অমন মার্তৃমূর্তি তিনি কিংবদন্তি শিল্পী কার্তিক পাল। তবে এবার থেকে আর প্রতিমায় পড়বে না তাঁর তুলির টান। রবিবার রাতে প্রয়াত হলেন শিল্পী।
গত এক দশকে কলকাতার পুজোর চালচিত্রে অনেক বদল এসেছে। সাবেকি পুজোর জায়গা দখল করে নিয়েছে নিত্যনতুন থিমের আমদানি। আঙ্গিক থেকে প্রচারে এসেছে কর্পোরেট ছাপ। তবু এ সবের মধ্যেও কোথাও যেন উজানস্রোতে হাল ধরে বসেছিলেন শিল্পী কার্তিক পাল। আর তাঁর বাগবাজার সার্বজনীনের পুজো। বাঙালির নস্ট্যালজিয়ার আঁচলে গিঁট বাঁধা যে দুর্গাপুজোর স্মৃতি, তাই-ই বছর বছর ফিরিয়ে আনতেন তিনি। আর সে মাতৃমূর্তির দিকে তাকিয়ে ফিকে হয়ে যেত বহু প্রচারের হরেক পুজোর জৌলুস। আর্ট কলেজে পড়া হয়নি। মৃদু আক্ষেপ ছিল তা নিয়ে। কিন্তু তার জন্য থেমে যাননি। মাটির সঙ্গে ঘর করা সেই ছেলেবালা থেকেই। বাবা জিতেন পালের কাছ থেকেই শিখেছিলেন কী করে সামান্য মাটিকে বদলে ফেলা যায় মূর্তিতে। সেই সঙ্গে মিশেছিল তাঁর কল্পনা। কে বলে দেবীর চক্ষুদান শুধু তুলির টানে! আসলে তো শিল্পীর দরদেই তা ফুটে ওঠে। স্মৃতিচারণ করতে করতে ছেলেবেলায় ফিরে গিয়েছিলেন শিল্পী-পুত্র নব পাল। বলছিলেন, “ছোটবেলা থেকে আমাদের খেলার ঘর বলুন আর যাই বলুন, সব ওই ঠাকুর তৈরির জায়গাতেই। বাবাকে দেখতাম তন্ময় হয়ে কাজ করছে। উপর থেকে নামছেই না। আমাদের প্রথম প্রথম দেবীর চোখ আঁকতে দিত না। আমরা হাঁস, ময়ূর এসবের চোখ আঁকতাম। ঠাকুরের চোখ দেওয়া বাবার কাছে একটা বিরাট কাজ ছিল। অনেকটা বড় হওয়ার পরই সে সুযোগ পেয়েছি।”
থিমের বাজারেও সাবেকিয়ানাকে আঁকড়ে থাকতেই ভালবাসতেন শিল্পী কার্তিক পাল। নিজে আর্ট কলেজে পড়তে পারেননি। সে খেদ মিটিয়েছিলেন ছেলেক পড়িয়ে। থিমশিল্পী হিসেবে ছেলে যখন শহরে নাম করেছে, তখন থিম ব্যাপারটা একটু আধটু মেনেও নিয়েছিলেন। কিন্তু বাগবাজারের পুজো ছিল তাঁর প্রাণ। নববাবু জানাচ্ছিলেন, বাগবাজার সার্বজনীনের সব মাপ ছিল তাঁর মুখস্থ। শেষের দিকে বয়সের কারণে নিজে কাজ করতে পারতেন না। কিন্তু তদারকি করতেন। সেই কাজে ইতি পড়ল। তবে শিল্পী বেঁচে থাকেন তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে। কার্তিক পাল যেমন থেকে যাবেন নব পালের কাজের আঙ্গিকে। কিন্তু এরপর কি সেই চিরাচরিত মাতৃমূর্তিতে বদল আসবে? ‘একদমই না’, বললেন নব পাল, ‘আমি চাই না বাবার কাজের ধারায় পরিবর্তন করতে। কোনও এক্সপেরিমেন্টও করতে চাই না। যে মান বাবা তুলে ধরেছিলেন, তাই-ই বরং বজায় রাখতে চাই।’
জীবনের অমোঘ নিয়মেই জীবন ছেড়ে পরলোকে পাড়ি দিতে হল শিল্পী কার্তিক পালকে। তবু শিল্পীর মৃত্যু হয় না। দুর্গাপুজোর মতো নন আর্কাইভাল শিল্পে পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো তাঁর কাজের সাক্ষী থাকতে পারবে না। তবু বাগবাজার সার্বজনীনের মাতৃমূর্তির চোখের দিকে তাকালে হয়তোই প্রয়াত শিল্পীকে খুঁজে পাবেন বহু বাঙালিই। বাবাকে বাঁচিয়ে রাখবেন তাঁর শিল্পী-পুত্রই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.