অভিরূপ দাস: মনের দ্বারা চালিত হয়ে নিজের বিপদ ডেকেছিলেন দুর্যোধন। এমনই হাল হবে দমদমের (Dum Dum) ঊষসী চক্রবর্তীর। ঋতুমতী হয়ে সরস্বতী পুজো (Saraswati puja) করায় তরুণীর ভবিষ্যৎ নিয়ে নিদান দিলেন পুরোহিতদের একাংশ। তাঁদের কথায়, রঘুনন্দনের শুদ্ধিতত্ত্ব মেনেই পুজো হয় বাংলা, বিহার, ওড়িশায়। তাকেই উপেক্ষা!
সরস্বতী পুজোর দিনে নিজেই মন্ত্রপাঠ করেছেন তরুণী। তাও কিনা ঋতুমতী (Menstruation) অবস্থায়! সোশ্যাল সাইটে ছবি দিয়ে ঊষসী লিখেছেন, ‘‘জীবনে প্রথমবার সামবেদ মেনে নিজেই নিজের বাড়ির সরস্বতী পুজো করলাম। আজ আমার দ্বিতীয় দিন।’’ এমন ঘটনায় তোলপাড় সোশ্যাল মিডিয়া। কেউ ‘গেল গেল’ রব তুলেছেন। কেউ বলছেন নারীর ক্ষমতায়নের যুগে এটা স্বাভাবিক। ঋতুমতী অবস্থায় পুজো করা নিষেধ বলেই সাধারণত ধরা হয়। কালীঘাট সেবাইত কমিটির সদস্য সন্দীপ হালদার জানিয়েছেন, ঋতুমতী অবস্থায় কোনও মহিলাকে কালীঘাট মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। মনে করা হয় ওই সময় তাঁরা অশুচি থাকেন।
তবু কেন এমতাবস্থায় পুজো করলেন ঊষসী? তাঁর কথায়, “ঋতুমতী হলে পুজো করা যায় না এমন নিয়ম আমি মানি না। মনে করি এটা একটা কুসংস্কার। পুজো করতে গেলে শুধুমাত্র নিষ্ঠা আর ভক্তির প্রয়োজন। সমস্ত আচার-নিয়ম মেনেই আমি পুজো করেছি।” যদিও সে পুজো সরস্বতী গ্রহণ করেননি বলেই জানিয়েছেন শহরের শাস্ত্রজ্ঞরা। রাজপুরোহিত যুগলকিশোর শাস্ত্রীর কথায়, ধর্ম মেনে এ কাজ হয়নি। শাস্ত্রে বলে দুর্যোধন মনময়ো, যুধিষ্ঠির ধর্মময়ো। অর্থাৎ মহাভারতে দুর্যোধন মনের কথা শুনেছিলেন আর যুধিষ্ঠির ধর্মের কথা শুনেছিলেন। দুর্যোধন তার শাস্তিও পেয়েছিলেন। এক্ষেত্রেও তাই হবে।
রজঃস্বলা অবস্থায় পুজো করা প্রসঙ্গে প্রবীণ শাস্ত্রজ্ঞ জানিয়েছেন, মেয়েদের যে কোনও মূহূর্তে ঋতুস্রাব হতে পারে। আর রক্তপাতকে পুজোয় অশৌচ হিসাবে ধরা হয়। তাঁর ব্যাখ্যায়, এটা পুরুষদের জন্যও প্রযোজ্য। একে বলে ক্ষত-অশৌচ। পুরাণে চাণক্য মহারাজ নন্দের পিতৃশ্রাদ্ধে গিয়েছিলেন। কিন্তু পা কেটে যাওয়ায় শ্রাদ্ধের কাজে অংশ নিতে পারেননি চাণক্য। শাস্ত্রজ্ঞদের কথায়, এমন অশৌচের মধ্যেই রয়েছে মরণ-অশৌচ, পক্ষিণী-অশৌচ। পাখি ঠুকরে দিলেও পুজো করা যায় না।
যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীর ঘটনা আলাদা। মা সারদা ঋতুস্রাব চলাকালীন ঠাকুরের পুজো করতেন, বানাতেন ভোগও। তাঁর স্বামী তাঁকে বাধা তো দেনইনি, বরং জুগিয়েছেন উৎসাহ। ঊষসীর এহেন কাজে তাই ভুল কিছু দেখছেন না অনেকে। পুরাণ বিশারদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর কথায়, ”ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি ঋতুমতী অবস্থায় পুজো করায় কোনও অপরাধ নেই।” শাস্ত্রের নিয়মকে ব্যাখ্যা করে তিনি জানিয়েছেন, পুরাণে মনে করা হয় ঋতুমতী মহিলা অপবিত্র। কিন্তু এর পিছনে তো একটা আয়ুর্বেদিক কারণ আছে। প্রতিটি সংসারে মেয়েরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। পুরুষ মানুষের মানসিকতাই থাকে মেয়েদের খাটিয়ে নেওয়া। আয়ুর্বেদিক ধারণা মতে এ সময় মেয়েদের বিশ্রাম দরকার। ঋতুস্রাবের সময় তাঁরা ক্লান্ত থাকেন। কিন্তু ধর্মের নাম না করলে সে রেহাইও মিলত না।”
বছর কয়েক আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক এবং পুরোহিত নন্দিনী ভৌমিককে দেখে অভ্যস্ত চোখে ধাক্কা লেগেছিল নগরবাসীর। ঋতুমতী অবস্থায় মহিলারা শুদ্ধ নন, এই যুক্তিতে শবরীমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। যে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা করেছিল ইন্ডিয়ান ইয়ং ল’ইয়ারস অ্যাসোসিয়েশন। ঊষসী বলছেন, ”কোনও হুমকিতেই ভয় পাচ্ছি না।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.