প্রতীকী ছবি।
ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: ওষুধ লেখার জন্য ডাক্তারদের পিছনে কোনও টাকা খরচ করা হয় না। তাঁদের জন্য দামি উপঢৌকন কিংবা বিদেশ ভ্রমণ অথবা লাঞ্চ-ডিনার কিংবা হোটেল স্টে-র পিছনে অর্থব্যয় করা হয় না। রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ছাড়া ‘ফ্রি স্যাম্পল’ দেওয়া হয় না কাউকে। শিক্ষামূলক কোনও অনুষ্ঠান স্পনসর করা হয় না কোনও হোটেল বা গেস্ট হাউসে। স্বচ্ছ, মসৃণ ও নৈতিক ব্যবসার স্বার্থে এবার এই মর্মে রাজ্য সরকারকে হলফনামা দিতে হবে সব ওষুধ সংস্থাকে। সেই হলফনামা রাজ্য পাঠাবে কেন্দ্রীয় সার ও রসায়ন মন্ত্রকের অধীন ড্রাগ কন্ট্রোল বিভাগে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সার ও রসায়ন মন্ত্রকের অধীন ওষুধ বিভাগ ‘ইউনিফর্ম কোড ফর ফার্মাসিউটিক্যাল মার্কেটিং প্র্যাকটিসেস’ (ইউসিপিএমপি-২০২৪) পরিমার্জন করে তা প্রকাশ করেছে বিজ্ঞপ্তি হিসেবে। সেটাই অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ফার্মা কোম্পানিদের। রাজ্যের তরফে চিঠিতে বলা হয়েছে, এ নিয়ে দেশের প্রতিটি ওষুধ কোম্পানির মালিক অথবা সিইও কিংবা ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে ফি বছর ৩০ জুনের মধ্যে হলফনামা জমা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশের আশা, এতে ফার্মা কোম্পানিগুলির বিপণনে স্বচ্ছ্বতা আসবে।
যদিও অন্য একটি অংশ মনে করে, আখেরে এতে লাভ কিছু হবে না। কেননা, আমজনতাকে নিষ্কৃতি দিয়ে ওষুধের দাম এতে কমার সম্ভাবনা নেই। চিকিৎসক সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের সভাপতি কৌশিক চাকী বলেন, ‘ইলেক্টোরাল বন্ডে কেন্দ্রের শাসকদলকে কোন কোম্পানি কত কোটি টাকা দেবে বা দেবে না, তা কি বলা আছে ইউসিপিএমপি-তে? বলা নেই। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তাই ওষুধের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধির দায় জনতাকেই নিতে হবে।’ তিনি বিশ্বাস করেন, অধিকাংশ চিকিৎসকই ফার্মা কোম্পানিদের থেকে উৎকোচ নেন না। তবে হ্যাঁ, কনটিনিউয়িং মেডিক্যাল এডুকেশন (সিএমই)-এর মতো বিভিন্ন শিক্ষামূলক কর্মসূচিতে ওষুধ সংস্থার থেকে স্পনসরশিপ নেওয়ার চল আছে বলে মানেন তিনি।
বলা হয়েছে, সিএমই-র মোড়কে হওয়া কোনও কনফারেন্স, সেমিনার, ওয়ার্কশপ ইত্যাদির পিছনে যে টাকা খরচ হবে, তার স্বচ্ছ্ব ও নৈতিক অডিট করতে হবে। এবং এই ধরনের কর্মসূচি আয়োজন করতে হবে মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, টিচিং কিংবা রিসার্চ ইনস্টিটিউট অথবা হাসপাতালের মধ্যে। বলা হয়েছে, কোনও চালু ওষুধ বিপণনের ক্ষেত্রে সেটিকে ‘নতুন’ ওষুধ বলে চালানো যাবে না। কোনও ওষুধকে অনর্থক ‘নিরাপদ’ বলেও দাবি করা যাবে না। মন্ত্রক সূত্রে খবর, আগেও এমন ধরনের ‘কোড অফ এথিক্স’ ছিল। কিন্তু বিষয়টি ঐচ্ছিক হওয়ায় তেমন কাজ হচ্ছিল না। তাই নীতি আয়োগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সদস্য বিনোদকুমার পলের নেতৃত্ব পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি নতুন বাধ্যতামূলক ‘ইউনিফর্ম কোড’ তৈরি করেছে।
যদিও সোসাইটি ফর সোশ্যাল ফার্মাকোলজির তরফে ওষুধবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ স্বপনকুমার জানা মনে করেন, ‘এই সব নিয়ম কার্যকর করে খুব একটা লাভ হবে না। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসা পরিষেবা ও ওষুধ আদতে পণ্য। এই দু’টির নেপথ্যে ব্যবাসীয়রা রয়েছেন। এবং সেই ব্যবসার মূল চালিকাশক্তি হলো পুঁজি ও মুনাফা। সেখানে অযথা নৈতিকতা আশা করে লাভ নেই। আগামী দিনে নতুন কোনও অনৈতিক উপায় ঠিকই খুঁজে বের করে নেবেন ব্যবসায়ীরা।’
সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সজল বিশ্বাস জানাচ্ছেন, এতে মানুষের মাথাব্যথা কমবে না। কেননা, ওষুধের দাম কমার কোনও দিশা এই ইউসিপিএমপি-তে নেই। তাঁর কথায়, ‘ওষুধের বাজারমূল্য ওষুধ কোম্পানিগুলোই ঠিক করে। বর্তমানে যেখানে ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের উৎপাদন খরচের উপর ১০০০-৩০০০% পর্যন্ত লাভ করে থাকে, সেখানে ওষুধ বিপণনের জন্য তারা চিকিৎসকদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য উৎপাদনমূল্যের ২-৩% খরচ করে বড়জোর। ফলে অনর্থক এই সব ইউনিফর্ম কোড তৈরি করে আসলে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে জনতার।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.