ছবি: প্রতীকী
রাহুল রায়: দেহের উপর অধিকার কার? কে করবে সৎকার? একদিকে পরিচারিকা, অন্য দিকে আত্মীয়। দু’পক্ষের আইনি টানাপোড়েনে মৃত্যুর পর দু’বছর মর্গেই পড়ে রইল মৃতদেহ। অবশেষে জট খুলল কলকাতা হাই কোর্টের (Calcutta High Court) নির্দেশে। বুধবার বিচারপতি শম্পা সরকারের নির্দেশ, আগামী ১১ জুলাই, সোমবার দাবিদার দু’পক্ষেরই উপস্থিতিতে এবং পুলিশের সহযোগিতায় দেবাশিস দাস নামে ওই প্রৌঢ়ের মৃতদেহের সৎকার করতে হবে এবং দু’পক্ষকেই ডেথ সার্টিফিকেট দিতে হবে। প্রসঙ্গত, দিনকয়েক আগে সম্পত্তিগত বিবাদের জেরে কাটোয়ার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধার দেহ হাসপাতালের মর্গে পড়ে থাকার বিষয়টি হাই কোর্টের সামনে এসেছে। তার রেশ না কাটতেই এই ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
নতুন ঘটনাটি দক্ষিণ কলকাতার। আদালতের খবর, ২০২০ সালের জুলাইয়ে আনন্দপুর থানা এলাকার মাদুরদহের বাসিন্দা, বছর আটান্নর দেবাশিস দাস হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ১১ জুলাই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। তারপরই জটিলতার সূত্রপাত। কী রকম? অবিবাহিত দেবাশিসবাবু ছিলেন মা-বাবার একমাত্র সন্তান। মা-বাবা প্রয়াত হওয়ার পরে নিজেদের বাড়িতে একাই থাকতেন, বিবিধ সামাজিক কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন। আর তাঁকে দেখাশোনা করতেন পরিচারিকা চন্দ্রমণি মণ্ডল। দেবাশিসবাবুর মরদেহ সৎকার করতে চেয়েছিলেন চন্দ্রমণি। কিন্তু পরিবারের কেউ না হওয়ায় তাঁর আরজি টেকেনি, হাসপাতাল থেকে পুলিশ, সর্বত্র দরবার করেও তিনি বিফল হন। শেষমেশ মৃতদেহের অধিকার চেয়ে হাই কোর্টে মামলা করেন।
এমতাবস্থায় বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা মৃতদেহের ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেন। এনআরএসে ময়নাতদন্ত হয়। কিন্তু সৎকারের দায়িত্ব কে নেবে, আদালত সে ব্যাপারে কোনও নির্দেশ না দেওয়ায় দেবাশিসবাবুর মরদেহের ঠাঁই হয় এনআরএসের মর্গে। মামলা চলতে থাকে। দেবাশিসবাবুর মৃত্যুর মাস তিনেক বাদে খবর পেয়ে দেহের দাবি জানাতে আসেন বেলেঘাটার জনৈক অনিন্দ্য ঘোষ, এবং তিনিও মামলায় পক্ষ হয়ে যান। অনিন্দ্যবাবুর আইনজীবী সব্যসাচী রায়ের কথায়, “আমার মক্কেল দেবাশিসবাবুর নিজের মাসির ছেলে। তাই মৃতদেহের সৎকারে ওঁরই একমাত্র অধিকার।”
সেই থেকে মাসের পর মাস ধরে মামলার জল গড়িয়েছে। দেবাশিসবাবুর দেহ রয়ে গিয়েছে এনআরএসের মর্গে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একাধিকবার পুলিশকে বলেছেন দেহটি সরাতে, কিন্তু আইনি গেরোয় তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। দু’বছর বাদে অবশেষে অচলাবস্থার ফয়সালা হল বুধবার, বিচারপতি শম্পা সরকারের এজলাসে। বুধবার শুনানিতে পরিচারিকার কৌঁসুলি অর্জুন সামন্ত ও সূর্যপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় দাবি করেন, “চন্দ্রমণি যখন অনেক ছোট, তখন থেকেই উনি দেবাশিসবাবুর দেখাশোনা করেছেন। বারো বছরের বেশি ওই বাড়িতে কাজ করেছেন। দেবাশিসবাবুর চিকিৎসা থেকে শুরু করে যাবতীয় দায়দায়িত্ব সামলেছেন। যে কারণে ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর দেবাশিসবাবু তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি চন্দ্রমণির নামে উইল করে দেন। তাই ওঁর মরদেহের সৎকারের দায়িত্বও চন্দ্রমণির।”
বস্তুত মৃতদেহ সৎকারের টানাপোড়েনের নেপথ্যে প্রায় কোটি টাকার সম্পত্তির অধিকারের ছায়াটাই দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়েছে এদিনের সওয়ালে। অনিন্দ্যবাবুর আইনজীবীর দাবি, “যে উইলের নথি আদালতে পেশ করা হয়েছে, তার গ্রহণযোগ্যতা নেই। কারণ, ওটা রেজিস্ট্রি করা হয়নি।” অন্য দিকে চন্দ্রমণির আইনজীবীর মন্তব্য, “দেবাশিসবাবুর জীবিতাবস্থায় কেউ ওঁর খোঁজ নেয়নি। সে সময় সব দায়িত্ব সামলেছেন পরিচারিকা। এখন আত্মীয় হয়ে এসে দাবি জানানোর মানে কী?”
সরকারি কৌঁসুলি অমিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “২০২০-র জুলাইয়ে দেবাশিস দাসের মৃত্যুর পরে হাসপাতালে মৃতদেহের অধিকার চেয়ে দাবি জানিয়েছিলেন তাঁর পরিচারিকা চন্দ্রমণি। কিন্তু তিনি দেবাশিসবাবুর পরিবারের সদস্য না হওয়ায় দেহ পাননি। সঠিক দাবিদারের অভাবে মৃতদেহের গতিও এত দিন করা যায়নি। এবার আদালতের নির্দেশে সৎকার হবে।” সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে হাই কোর্ট এদিন কোনও নির্দেশ দেয়নি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.