সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ২০১২ থেকে ২০২২। ‘সাজানো ঘটনা’ বনাম ‘ঘটনাটা ধর্ষণেরই’। পার্ক স্ট্রিট থেকে হাঁসখালি-দেগঙ্গা-মাটিয়া-বাঁশদ্রোণী। মাঝখানে পেরিয়ে গিয়েছে পাক্কা এক দশক। আবার শিরোনামে দময়ন্তী সেন। সেই ধর্ষণ মামলা। সেই তদন্তভার। দুঁদে আইপিএসের উপরই যে ধর্ষণের মতো ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবু রাজ্য-রাজনীতির নিরিখে এ সিদ্ধান্ত বহন করছে অন্য তাৎপর্য। কেননা এই ধর্ষণের তদন্তে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার দরুণই একদিন তাঁকে সরতে হয়েছিল যুগ্ম কমিশনার(ক্রাইম) পদ থেকে।
২০১২ সাল। প্রকাশ্যে আসে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ড। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (CM Mamata Banerjee) সেদিন জানিয়েছিলেন, ঘটনাটি সাজানো। তদানীন্তন পুলিশ কমিশনার সহমত হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। জানিয়েছিলেন, পুলিশের ভাবমূর্তি অহেতুক নষ্ট করা হচ্ছে। ঘটনাটিকে তেমন আমল দিতে রাজি ছিলেন না পুলিশ-প্রশাসনের দুই শীর্ষ ব্যক্তিত্ব। কিন্তু এহেন পরিস্থিতিতেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন দময়ন্তী। প্রশাসনের ইঙ্গিত তাঁর তদন্তের অভিমুখ বদলে দিতে পারেনি। দময়ন্তী সাফ জানিয়েছিলেন, কিছু একটা ঘটেছে। আর ঘটনাটা ধর্ষণেরই।
আজও অনেকেই বলে থাকেন, সেদিন প্রায় একরকম নিজের জেদেই পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডের তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যান দময়ন্তী (Damayanti Sen)। মূল অভিযুক্ত অধরা থাকলেও, একে একে ধরা পড়তে থাকে অন্য অভিযুক্তরা। কিন্তু আচমকাই পটবদল। তদন্তের সাফল্য যেন রাতারাতি বদলে গেল দুর্ভাগ্যে। মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের পর দময়ন্তী জানিয়েছিলেন, এই সাফল্য তাঁর একার নয়। পুরো টিমের। পুলিশ কমিশনারের নির্দেশেই কাজ হয়েছে। রাজনীতির অন্দরে কান পাতলে শোনা যায়, চাপের মুখেই নাকি সেদিন কথাগুলো বলেছিলেন তিনি। সেদিন দুঁদে আইপিএস দময়ন্তীর চেহারাতেও নাকি চাপের ছাপ ছিল স্পষ্ট। বদলি যেন ছিল ভবিতব্যই। গোয়েন্দাপ্রধানের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে দময়ন্তীকে সরিয়ে নিয়োগ করা হয় রাজ্য পুলিশের ডিআইজি (প্রশিক্ষণ) পদে।
অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দময়ন্তীর পুলিশে চলে আসাটা খানিকটা আকস্মিকই বলতে হয়। শোনা যায়, চেয়েছিলেন আইএএস হতে। বদলে পরীক্ষা দিয়ে পেয়েছিলেন আইপিএস। ১৯৯৬ ব্যাচের দময়ন্তীর উত্থান ছিল নজরকাড়া। দক্ষিণ ২৪ পরগনার অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ সুপার (টাউন) থেকে শুরু করে দ্রুত এসপি, কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি কমিশনার থেকে জয়েন্ট কমিশনার ক্রাইম। কেরিয়ারের এই ঊর্ধমুখী গ্রাফই দেয় তাঁর দক্ষতা এবং মেধার পরিচয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেন সব ওলটপালট করে দিয়েছিল পার্ক-স্ট্রিট কাণ্ড। আপাতভাবে পরাজয় মনে হলেও দময়ন্তীর কাছে সম্ভবত তা হার ছিল না। অপরাধীকে খুঁজে বের করাই যাঁর একমাত্র লক্ষ্য, চাকরির উত্থান-পতন তাকে কি ততটা বিচলিত করেছিল? উত্তর যদিও মেলে না। তবু পুলিশের সাহসিকতার প্রশ্ন যখনই এসেছে, নিরপেক্ষ তদন্তের প্রসঙ্গ যখনই উঠেছে তখনই একবার না একবার ঠিক উঠে এসেছে দময়ন্তীর নাম। কেউ কেউ বলে থাকেন, দময়ন্তী খানিকটা কম গুরুত্বপূর্ণ পদে সরে গেলেও, তিনি যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাননি, এটাই তাঁর সাফল্য।
আর এবার তাঁর হাতেই রাজ্যের সাম্প্রতিক চারটি ধর্ষণের ঘটনার তদন্তভার সঁপে দিল কলকাতা হাই কোর্ট। আদালত জানিয়েছে, যদি আপত্তি থাকে তবে আদালতকে তিনি তা জানাতে পারেন। যদিও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আপত্তি জানাননি দময়ন্তী। ফলত ধরে নেওয়া যাচ্ছে, আবার স্বমহিমায় ফিরলেন তিনি। এমন একটা সময়ে তিনি ফিরলেন, যখন রাজ্যে প্রকাশ্যে আসছে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা। হাঁসখালি ধর্ষণ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে ক্ষোভ জমেছে রাজ্যবাসীর একাংশের মনেও। সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্তত সে ছবিই উঠে আসছে। ঠিক তখনই অপরাধী খোঁজার দায়িত্ব পেলেন তিনি, অপরাধী খোঁজার ‘অপরাধে’ যাঁকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল বলেই বিশ্বাস করে থাকেন অনেকে। আর তাই দময়ন্তী তদন্তভার পেতেই ফের নতুন চর্চা শুরু হয়েছে রাজ্য-রাজনীতির অন্দরমহলে। কেউ কেউ বলছেন, কামব্যাক শুধু সিনেমাতে নয়, বাস্তবেও হয়। আর কে না জানে, কল্পনার থেকেও শক্তিশালী যদি কিছু থেকে তবে তা বাস্তবই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.