গৌতম ব্রহ্ম: বোঝার উপর শাকের আঁটি! একে করোনায় রক্ষে নেই, ডেঙ্গু দোসর! বাস্তবিকই কোভিডের সঙ্গে জোট বেঁধে ডেঙ্গু এখন যেভাবে কাদাজল আরও ঘোলা করে তুলছে, তাতে অশনি সঙ্কেত দেখছেন চিকিৎসকরা। তাঁরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে করোনা-ডেঙ্গু যুগলবন্দি পরিস্থিতি জটিল করে বাড়িয়ে দিচ্ছে মৃত্যুর ঝুঁকি। নিছক আশঙ্কা যে নয়, দক্ষিণ কলকাতার অশোকনগরের ঘটনা তারই প্রমাণ। জোট বেঁধে একই রোগীকে ছোবল দিল কোভিড ও ডেঙ্গু। যৌথ হামলায় প্রাণও গেল রোগীর।
গত ১ জুলাই অসুস্থ হন ওই প্রৌঢ়। ধুম জ্বর। এম আর বাঙুর হাসপাতালে ৪ জুলাই তাঁর লালারস পরীক্ষা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। ৫ জুলাই রিপোর্ট আসে, করোনা পজিটিভ। বাড়ির লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, রোগী মারা গিয়েছেন। তাঁর ডেঙ্গুর রক্তপরীক্ষাও হয়েছিল। মঙ্গলবার সেই এনএসওয়ান রিপোর্টও পজিটিভ। অর্থাৎ, উনি ডেঙ্গুতেও আক্রান্ত ছিলেন। একই শরীরে কোভিড-ডেঙ্গুর ছোবল ও মৃত্যু সম্ভবত রাজ্য তথা দেশে এই প্রথম। স্বাভাবিকভাবেই চিকিৎসক মহলে আলোড়ন, আলোচনা। কোভিড-রোগীর কি ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়া হতে পারে?
সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে দুই কোভিড রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে ফেরার পর দেখা যায়, দু’জনেরই ডেঙ্গু হয়েছে। থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রে অবশ্য উলটো হয়েছে। এক ডেঙ্গু রোগী সেরে ওঠার মুখে হঠাৎই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। দেখা যায় রোগীর শরীরে বাসা বেঁধেছে কোভিডও। এই তিনটি ঘটনার উদাহরণ টেনে সম্প্রতি একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ‘দি সোসাইটি ফর হেলথ কেয়ার এপিডোমোলজি অফ আমেরিকা’—তে। চিনের গুয়াংঝাউ সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোলের গবেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, এই সময় থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ডেঙ্গুর সঙ্গে জোট বেঁধে করোনা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। চিকিৎসকদের একাংশের পর্যবেক্ষণ, কোভিডে আক্রান্ত হলে বাড়তি হিসেবে ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা এতটুকুও কমে না। কো-ইনফেকশন হতেই পারে। এবার দেখতে হবে, কে আগে শরীরে ঢুকেছে।
ডাক্তারবাবুদের অনেকের অভিমত, শত্রুর সংখ্যা বাড়লে লড়াইটাও কঠিন হয়ে যায়। বাড়ে মৃত্যুর আশঙ্কা। সম্ভাবনা। যদিও এ নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন। কোভিড-ডেঙ্গু সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, রক্তের শ্বেত রক্তকণিকার হরেক কোষ রয়েছে- নিউট্রোফিল, বেসোফিল, ইউসিনোফিল, মনোসাইট, লিম্ফোসাইট, ডেনড্রাইটিক সেল, ন্যাচারাল কিলার সেল ইত্যাদি। এদের মধ্যে নভেল করোনা হামলা চালায় লিম্ফোসাইট, মনোসাইট, ডেনড্রাইটিক সেলের উপর। সেক্ষেত্রে ‘ইন্টারলিউকিন ৬’ নামে এক ধরনের কোষের রস বা সাইটোকাইন নিঃসৃত হয়। যা সাইটোকাইন স্টর্ম তৈরি করে রক্তনালি ফুটো করে। এবং ফাইব্রিন জালিকা তৈরি করে প্লেটলেটের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। অন্যদিকে ডেঙ্গুও হামলা চালায় প্লেটলেট বা অনুচক্রিকার উপর। সুতরাং করোনা রোগীর দেহে ডেঙ্গু ছোবল দিলে পরিস্থিতি জটিল হতে বাধ্য। এমনটাই জানিয়েছেন ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. সিদ্ধার্থ জোয়ারদার।
ডেঙ্গুতে ‘ক্যাপিলারি লিক’ হয়। রক্তজালিকা থেকে রক্তরস বাইরে চলে যাওয়ার জন্য রক্ত গাঢ় হয়ে যায়। সেই কারণে ফ্লুইড থেরাপিই হচ্ছে ডেঙ্গু চিকিৎসার প্রধান উপায়। এমনই পর্যবেক্ষণ চিকিৎসক নিশান্তদেব ঘটকের। তিনি জানালেন, করোনাতেও রক্ত জমাট বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কোভিড রোগীর একটা বড় অংশের মৃত্যুর কারণ ‘পালমোনারি থ্রম্বো এমবলিজম’। ডেঙ্গুতেও রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা। ফলে জটিলতা বাড়বে বই কমবে না। বরং দু’টোকে একসঙ্গে সামাল দেওয়া মুশকিল। কারণ করোনায় রক্ত পাতলা রাখার জন্য অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে, ডেঙ্গুতে প্লেটলেট স্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ার ফলে রোগীর রক্তক্ষরণের প্রবণতা দেখা যায়। সেক্ষেত্রে অ্যান্টিকোয়াগুলেন্টের ব্যবহার বিষবৎ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.