কলহার মুখোপাধ্যায়, বিধাননগর: পাশাপাশি তিনটে ঘর। মাঝেরটায় ন’বছরের করোনা আক্রান্ত ছেলে। দু’পাশের দুটো ঘরে বাবা আর মা। তাঁরা সকলেই করোনা পজিটিভ। তিনজনের মাঝে ৫ ইঞ্চি দেওয়ালের গাঁথনি। তা ভেদ করে যতটুকু শব্দ ঘরে প্রবেশ করতে পারছে, সেটুকুই সারাদিন কথোপকথন চালানোর অবলম্বন। টানা ১০ দিন ছেলের মুখ দেখেননি মা। খাবারদাবার দরজার বাইরে রেখে ঢুকে যেতে হচ্ছে নিজের ঘরে। ছেলেটা একা ঠিকমত খেতে পারছে কি? করোনা আতঙ্ক মায়ের মনও নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই। ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ এক বিচিত্র দিনলিপি তৈরি করে দিয়েছে অসংখ্য মানুষের। বিধাননগর এলাকার শতাধিক মানুষ COVID-19 আক্রান্ত হয়ে নিজেদের ঘরে অন্তরীণ।
বাগুইহাটি থানার রঘুনাথপুরের এক অভিজাত আবাসন। সেখানকার একটি ফ্ল্যাটে ছ’টি বেডরুম। তিনটিতে রয়েছেন বাবা-মা এবং চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া পুত্র। বাবা সদ্য ফিরেছেন এক নামী বেসরকারি হাসপাতাল থেকে, করোনামুক্ত হয়ে। এক সপ্তাহ আগে মা-ছেলের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। তবে উপসর্গহীন হওয়ায় দু’জনেরই চিকিৎসা চলছে বাড়িতে। তাই পৃথক থাকার পর্ব চলছে। মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ । “ছেলেকে সামলে রাখা দায় হয়ে পড়েছে”- জানাচ্ছেন মা। তাঁর নিত্য চিন্তা, ভাল করে না খেয়ে ছেলেটা বুঝি রোগা হয়ে গেল। কেমন আছে সে, তাও তো চাক্ষুষ করতে পারছেন না যে!
একই অবস্থা বাগুইআটির এক বৃদ্ধের। একাকী ঘরের মধ্যে কাটিয়েছেন টানা ন’দিন। হোম ডেলিভারির খাবার মুখে রোচে না। স্ত্রী করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বৃদ্ধ নিজেও করোনা পজিটিভ। তবে উপসর্গহীন। তাই থাকতে হচ্ছে হোম কোয়ারেন্টাইনে। “টিভি দেখে আর কত সময় কাটে বলুন তো?”- আক্ষেপ করলেন বৃদ্ধ।
চিনার পার্কের বছর বত্রিশের যুবক। তাঁর করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ। কিন্তু জ্বর থাকায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে নিজেকে আলাদা করে ঘরবন্দি করে ফেলেছেন। স্ত্রী ঘরের দরজায় খাবার দিয়ে হাঁক পারছেন। একে অপরের মুখ দেখেন না বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল। পাশাপাশি ঘর, অথচ প্রয়োজনের কথা বলতে মোবাইলই ভরসা।
উত্তর অর্জুনপুরের ৬৭ বছরের বৃদ্ধ ছিলেন হোম কোয়ারান্টিনে। শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকায় বারাসতে এক বেসরকারি হাসপাতালে ভরতি করা হয় দিন পাঁচেক আগে। সংস্পর্শে আসার কারণে তাঁর একমাত্র ছেলে এখন গৃহবন্দি। বাবা-ছেলের সাক্ষাৎ নেই।
এদের সকলেরই বক্তব্য এক, কোয়ারেন্টাইন মানেই অসহনীয় অবস্থা। একমাত্র ভরসা বলতে টিভি, মোবাইল। তাতেই বা কতক্ষণ? ১৪ দিনের একাকীত্ব অনেককে মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত করে তুলছে, বলছেন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানুষগুলো।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.