কৃষ্ণকুমার দাস: চেতলার এক মহিলা প্রসবের যন্ত্রণা নিয়ে রাসবিহারীর বেসরকারি হাসপাতালে ভরতি হয়েছিলেন। সুস্থ সন্তান প্রসব হল। কিন্তু ক’দিন পর তিনি নিজেই হয়ে গেলেন করোনায় আক্রান্ত। শুধু প্রসূতি নয়, তাঁকে হাসপাতালে দেখতে আসা মা ও বোন, দু’জনেই এখন COVID-19’এর শিকার। তিনজনেই বাঙুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।আলিপুরের দুর্গাপুর লেনের যুবক মাথার টিউমারে ক্ষত হওয়ায় অপারেশনের জন্য এক হাসপাতালে ভরতি হন। টিউমার তো অপারেশন হল, কিন্তু চারদিন পর যুবকের দেহে করোনার উপসর্গ দেখে বাঙুরে পাঠালেন চিকিৎসকরা। পরিবারকে যেতে হল পুরসভার কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে।
প্রসূতি বা যুবক, দু’জনেই যখন ভরতি হন, তখন হাসপাতাল পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছিল যে রোগীর দেহে COVID-19 ভাইরাস নেই। কিন্তু তা হলে কোন পথে, কীভাবে দুই কমবয়েসি রোগী হাসপাতালে ভরতি হওয়ার চার-পাঁচদিন পর মারণ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হলেন? শহরের এমন বেশ কয়েকজন নতুন করোনা আক্রান্তের পরিবার ‘মেডিক্যাল হিস্ট্রি’ দিয়ে হাসপাতাল থেকে সংক্রমণ হওয়ার অভিযোগ জানিয়েছেন রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে পুরমন্ত্রী রবিবার জানিয়েছেন, “শহরের কিছু নার্সিংহোম ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে করোনা সংক্রমণ ঘটছে বলে রোগীর পরিবারের তরফে গত কয়েকদিন ধরে অভিযোগ আসছে। ভর্তি হচ্ছে অন্য অসুখ নিয়ে, আর ক’দিন পর কোভিড-১৯ রোগী হয়ে যাচ্ছে।” খোদ হাসপাতাল থেকেই এবার করোনা সংক্রমণের নতুন রুট চালু হওয়ায় উদ্বিগ্ন পুরমন্ত্রী স্বাস্থ্যদপ্তরকে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও নজরদারি চালাতে বলেছেন। কারণ, ক্যানসার বা কিডনির অসুখ নিয়ে ভরতি হয়ে শেষে করোনা ধরা পড়ায় হাসপাতালে মারা গিয়েছেন এমন রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। বিশেষ করে কলকাতায় যখন পুরসভা নানা পদক্ষেপ নিয়ে Containment Zone কমিয়ে ফেলছে, তখন খোদ হাসপাতাল থেকেই নতুন করে করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর উদ্বিগ্ন রাজ্য সরকার। অন্য অসুখ নিয়ে তাই মানুষ হাসপাতালে যেতে ভয় পাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন পুরমন্ত্রী।
কলকাতার পাশাপাশি হাওড়া, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনার নানা নার্সিংহোম ও ছোটখাটো বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ, টাকার লোভে গোপনে COVID-19 রোগী ভরতি করে চিকিৎসা করালেও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি ও সুরক্ষা নেওয়া হচ্ছে না। ঠিক সময়ে স্যানিটাইজ না করায় নার্সিংহোমে ভাইরাস থেকে যাচ্ছে। একই অভিযোগ কিছু সরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধেও। এদিন স্বাস্থ্যভবনের এক শীর্ষকর্তা স্বীকার করেন, টাকার লোভে গোপনে করোনা চিকিৎসা করা এই ছোট নার্সিংহোমগুলি এখন করোনা সংক্রমণের নতুন ভরকেন্দ্র। বেসরকারি হাসপাতালগুলির সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ হসপিটালস অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’র ভাইস প্রেসিডেন্ট রূপক বড়ুয়া অবশ্য তাঁদের সংগঠনের চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে সংক্রমিত হওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। পালটা দাবি করেন, “হয়তো রোগীদের দেহে আগেই ভাইরাস ছিল। উপসর্গহীন হওয়ায় প্রথমে ধরা পড়েনি। চারদিন পর দ্বিতীয়বার করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ এসেছে।” তবে অন্য অসুখ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীর দেহে অনেক সময় উপসর্গহীন হয়ে থাকে COVID-19। সেই রোগীর চিকিৎসা করা ডাক্তার-নার্সরা জানতে পারেন না ওই উপসর্গহীন চিকিৎসাধীনের শরীর থেকে ভাইরাস তাঁদের শরীরে ঢুকে পড়েছে। এমন পথে অবশ্য ‘উপসর্গহীন’ রোগীর মাধ্যমে বেসরকারি হাসপাতালে আসা অন্য অসুস্থতার জন্য ভর্তি রোগীর দেহে করোনার সংক্রমণ ঘটতে পারে বলে স্বীকার করে নিয়েছেন রূপক বড়ুয়া।
স্বাস্থ্য ভবনের তরফে তথ্য, করোনা রোগীর ঘনিষ্ঠজন হয়েও কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে যেতে হবে ভেবে ভয়ে প্রথমে জানাচ্ছেন না। এমনকি করোনা পজিটিভ ধরা পড়ার আগে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করলেও গোপন করে ছিলেন। তারাই যখন পরে হাসপাতালে অন্য অসুখ নিয়ে ভরতি হচ্ছেন, তখন পরীক্ষায় ধরা পড়ছে। সংক্রমণের দায় পড়ছে হাসপাতালের উপরে। এদিন কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে থাকা আলিপুরের রোগীর পরিবারের সদস্য কানু রায়ের (নাম পরিবর্তিত) অভিযোগ, “ভাই গত এক মাস বাড়ির বাইরে যায়নি। হাসপাতালে ভরতির সময় লালারস পরীক্ষা হয়েছে। করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ ছিল বলে টিউমার অপারেশন হয়েছে। ভাইকে করোনা রোগী করে দিয়েছে ডাক্তার-নার্সরাই।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.