রিংকি দাস ভট্টাচার্য: বঙ্গ-শীতের উড়ানে দাঁড়ি টানতে পারে এল নিনো! অন্তত এমনই আশঙ্কা করছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। পাক্কা তিন বছর পর আবার ভয়াবহ চেহারায় আসছে ‘এল নিনো’। আগামী বছরের শুরুতেই। ডিসেম্বর পড়তেই তা তৈরি হতে শুরু করেছে। এ মাসের শেষের দিকে তা পূর্ণাঙ্গ রূপ নেবে বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। সম্প্রতি পুণের মৌসম ভবন থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, দেশের অন্যান্য জায়গার পাশাপাশি গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গেও এর প্রভাব পড়বে। শীতের মরশুমে (ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি) এই তল্লাটের গড় তাপমাত্রা ০.৫ ডিগ্রি বাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
[কর্পোরেট ধাঁচে মোবাইলেই মিলবে প্যাথলজি রিপোর্ট, কীভাবে জানেন?]
বস্তত, কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে এ বছর এমনিতেই দেরিতে ঢুকেছে শীত। দেরিতে এলেও অনুকূল পরিবেশ পেয়েই তা ডানা মেলতে শুরু করেছে। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের গোড়ায় কলকাতার তাপমাত্রা নেমে আসে ১৩-র ঘরে। পশ্চিমের জেলাগুলির পারদ ছিল ১০ ডিগ্রির নিচে। কিন্তু এরপরই ঘূর্ণিঝড় ‘ফেতাই’-এর ধাক্কায় ব্যাকফুটে চলে যায় শীত। প্রসঙ্গত, শীত নির্ভর করে উত্তুরে হাওয়ার উপর। এই সময় সাগরে নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় হলে বিপরীত বায়ুপ্রবাহের সূচনা হয়। উত্তুরে হাওয়ার পরিবর্তে সাগর থেকে জোলো বাতাস ঢুকে তাপমাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এল নিনো অর্থাৎ সাগরজলের উষ্ণতা বাড়লে তা ঘূর্ণিঝড়কে জলীয় বাষ্প জুগিয়ে শক্তির জোগান দেয়। এবছর ‘ফেতাই’কে নিয়ে উত্তর ভারত মহাসাগরীয় এলাকা (আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর যার অন্তর্ভুক্ত) সাতটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে, যা বিরল। একই বছর এতগুলি ঘূর্ণিঝড় শেষবার হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। এ বছর মে মাসে দু’টি ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল, ‘সাগর’ও ‘মেকুনু’। দু’টিরই জন্ম আরব সাগরে। সেপ্টেম্বরের শেষাশেষি ওড়িশায় আছড়ে পড়ে ‘দায়ী’। অক্টোবরে একই সময়ে দুই সাগরে প্রতাপ দেখিয়ে গিয়েছে দুই ঘূর্ণিঝড় ‘লুবন’ ও ‘তিতলি’। নভেম্বরে ‘গজ’ এবং ডিসেম্বরে ‘ফেতাই’।
সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ‘ইন্টার্ন-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’(আইপিসিসি) তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা দু’ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়বে। তাদের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। উত্তর ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় পরপর ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি সেই গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফল বলেই মনে করছেন তাঁরা। বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে তাপমাত্রার বদলের সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় তৈরির নিবিড় সম্পর্ক আছে। তার উপর, এ বছর তার মধ্যে এল নিনো (প্রশান্ত মহাসাগরের জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি) পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
[অনশন প্রত্যাহারের আরজি নিয়ে মাও নেতা অর্ণবের কাছে কারামন্ত্রী]
ভারত লাগোয়া দুই সাগরে (আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর) দু’দফায় আসে ঘূর্ণিঝড়ের মরসুম। প্রথমটা প্রাক বর্ষা, দ্বিতীয়টা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। গত কয়েক বছরের সাগরজলের উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং এর থেকে উদ্ভূত নিম্নচাপ-ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব যে শীতের আগমনকালে পড়ছে তা এক প্রকার নিশ্চিত আবহাওয়াবিদরা। যেমন, গত পাঁচ বছর ধরে শহর কলকাতাতে শীত ঢুকতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হয়ে যাচ্ছে। হাওয়া অফিসের দেওয়া তথ্য মোতাবেক, ২০১৪ ও ২০১৭ কে বাদ দিলে বাকি বছরগুলিতে মহানগরে শীত প্রবেশ করেছিল ডিসেম্বরে। ২০১৩ সালে মহানগরে শীত পা রেখেছিল ১৩ ডিসেম্বর। ওইদিন কলকাতার পারদ নেমেছিল ১৪.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। প্রসঙ্গত, সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রির নিচে নামলে শীতের আগমনকাল ধরা হয়। ২০১৫ তে শহরে শীতের ঢুকতে ১৭ ডিসেম্বর হয়ে গিয়েছিল। ওইদিন আলিপুরে তাপমাত্রা নেমেছিল ১৪.১ ডিগ্রিতে। ওই মাসেরই ১০ তারিখ কলকাতায় শীত ঢুকেছিল ২০১৬ সালে। ওইদিন মহানগরের তাপমাত্রা ছিল ১৪.৬।
কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দপ্তরের উপ মহানির্দেশক সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ভৌগোলিক অবস্থানের জেরে এমনিতেই কলকাতায় শীতের আয়ুকাল কম। সাগরের কাছাকাছি অবস্থান হওয়ায় শহরে কখনই টানা সাত-আটদিনের বেশি এখানে শীতের আবহ থাকে না। তার মধ্যে এল নিনোর প্রভাব পড়লে শহুরে শীত কিছুটা ধাক্কা খেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। তাহলে কী আগামী বছরের শুরুতেই শীতের দফারফা! তাঁর কথায়, গড় তাপমাত্রা বাড়ার অর্থ এই নয় যে, শীত পড়বে না বা ঠান্ডার আমেজ অনুভূত হবে না। “শীত পড়বে, নিয়ম মেনে নামবে তাপমাত্রাও। তবে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে শীতের স্থায়িত্বে।”-মন্তব্য সঞ্জীববাবুর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.