সন্দীপ চক্রবর্তী: নেতাজি (Subhas Chandra Bose) অন্তর্ধান রহস্যে নতুন মোড়। ডিএনএ টেস্ট, না কি রেনকোজি মন্দিরে রাখা চিতাভস্ম এনে পারলৌকিক ক্রিয়া বা শ্রাদ্ধ? এই প্রশ্নের আবহেই শুরু হল দেশনায়কের অন্তর্ধান রহস্য ঘিরে বিতর্কিত পর্বের নতুন অধ্যায়। নেতাজি সম্পর্কিত জনপ্রিয় গবেষক, লেখক ও ইতিহাসবিদ চন্দ্রচূড় ঘোষ বনাম নেতাজির পরিবারের অন্যতম সদস্য চন্দ্রকুমার বসু।
বিজেপিতে যোগদানকারী চন্দ্র বসু জাপান থেকে চিতাভস্ম এনে পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম করতে চেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। কিন্তু বড় প্রশ্ন, তাইহোকু বিমানবন্দরে দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসুর যে ‘মৃত্যু’ হয়েছিল, সে ব্যাপারে কীসের ভিত্তিতে তিনি নিশ্চিত হলেন! তাঁর বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বসু পরিবারেরই জীবিত অন্যতম বরিষ্ঠ সদস্য জয়ন্তী রক্ষিত। আর চন্দ্রচূড় ঘোষ তো চন্দ্র বসুকে মোক্ষম আক্রমণে বলেছেন, “উনি রাজনৈতিক অভিসন্ধিতে ও সংকীর্ণ পারিবারিক, ব্যক্তিগত স্বার্থে এমন মন্তব্য করেছেন।”
চন্দ্রচূড়ের প্রশ্ন, মনোজ মুখার্জি কমিশন যে রিপোর্ট দিয়েছিল, সেটা কেন মানা হয়নি? তাইওয়ান সরকার দুর্ঘটনার কথা অস্বীকার করা সত্ত্বেও সেই দুর্ঘটনা তত্ত্বে কেন অনড়? বেসরকারি হাতের লেখা বিশেষজ্ঞদের মত কেন উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? কেন শুধু সরকারি বিশেষজ্ঞদেরই মত নেওয়া হয়েছে? কেন সরকার বারবার মত চাপিয়ে দিয়েছে? কেন সিএফএসএলকে চাপ দিয়ে গুমনামী বাবার ডিএনএ পরীক্ষার ইলেকট্রোফেরোগ্রাম জনসমক্ষে আনা হচ্ছে না? ডিএনএ টেস্টের দাবিও তুলেছেন তিনি।
বিশ্বভারতী ও সাসেক্স ইউনিভার্সিটির প্রাক্তনী চন্দ্রচূড় ঘোষের যুক্তি
(১) ফাইল প্রকাশের ছ’বছর পরে চন্দ্র কী এমন দেখা গেল? কোন ফাইলের কোন পাতায় কী এমন তথ্য মিলল যে, প্রমাণিত হল বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়েছে! যাঁরা এই তত্ত্ব বলছেন, দেশবাসীকে খোলসা করাটা তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব।
(২) চন্দ্র বসু বা বসু পরিবারের যাঁরা এত দশক ধরে পণ্ডিত নেহরুকে দোষারোপ করে এসেছেন, তাঁদের এখন পণ্ডিত নেহরু ও কংগ্রেসের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
(৩) মিশন নেতাজির অনুজ ধর ও চন্দ্রচূড়ের কাছে বিমান দুর্ঘটনা ও নেতাজির মৃত্যু বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। তাঁরাও কেন্দ্রের প্রকাশ করা ৩০৩টি ও রাজ্যের প্রকাশিত ৬৪টি ফাইল দেখেছেন। তাই বসু পরিবারের ‘দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে বিশ্বাসী’ সদস্যদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন, সবটা জনসমক্ষে আনুন। প্রকাশ্যে বিতর্ক হোক। এতে দেশের স্বার্থ রয়েছে।
(৪) চন্দ্রকুমাররা অদ্ভুত যুক্তি দিচ্ছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার যেটা মেনে নেবে, সেটাই তাঁরা মেনে নেবেন। কেন্দ্র তো প্রথম থেকেই দুর্ঘটনার তত্ত্ব প্রমাণে ব্যস্ত ছিল। তা হলে পাঁচের দশক থেকে এতদিন কেন মেনে নেননি? মুখার্জি কমিশনের রিপোর্ট খারিজ করে দেওয়ার পর তো কেন্দ্রে চিঠি লিখেছিল বসু পরিবারেরই অংশ।
শরৎচন্দ্র বসুর মেজো ছেলে অমিয়নাথ বসুর পুত্র চন্দ্র বসু তাঁর এতদিনের মত থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরলেও মানছেন না জয়ন্তী রক্ষিত। তিনি এখন থাকেন বালিগঞ্জ পার্কে। ১৯৪২ সালে জন্ম। শরৎচন্দ্র বসু যখন মারা যান, তখন তাঁর বয়স আট। সুভাষচন্দ্রকে তিনিও দেখেননি। শরৎচন্দ্রের বড় সন্তান তাঁর বাবা স্বল্পবাক অশোকনাথ বসু যে অনেক কিছু চেপে রাখতেন, সেটা বুঝতে পারতেন। যেহেতু অশোকনাথরা সুভাষকে রাঙাকাকা বলে সম্বোধন করতেন, তাই জয়ন্তীর কাছেও সুভাষ রাঙাদাদাভাই। বারবার তাঁর কথায় ফৈজাবাদের সন্ন্যাসী সম্পর্কিত ঘটনা উঠে এসেছে।
বস্তুত, এই অন্তর্ধান রহস্যের বিতর্কিত মোড়ে জয়ন্তীদেবী ‘মিস’ করছেন ছোট কাকা সুব্রত বসু বা পিসি চিত্রা ঘোষকে। এমনও দাবি করলেন, “ছোট কাকা যখন সাংসদ, প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর একসঙ্গে রেনকোজির মন্দির থেকে চিতাভস্ম দেশে আনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ছোটকাকা স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, তিনি বেঁচে থাকতে এটা হতে দেবেন না। ছোট কাকা যেহেতু পরিবারে বড় ছিলেন, তাঁর কথাই সবাই শুনত।”
তা হলে চন্দ্রবাবুর দীর্ঘদিনের মত ও ভাবনায় ১৮০ ডিগ্রি বদল কেন?
জয়ন্তীদেবীর বক্তব্য, “স্বার্থসিদ্ধি বললে শুনতে খারাপ লাগে। ও তো আমাদের পরিবারেরই একজন। শুনেছি, বিজেপিতে পাত্তা পায় না। বাড়ির প্ল্যাটফর্ম ছিল, কিন্তু তেমন কিছু করতে পারল না।” অথচ চন্দ্র বসু ও পরিবারের সবাই মিলে সরকারের হাতে থাকা গোপন ফাইল প্রকাশের দাবিতে একজোট হয়েছিলেন। প্রথম বৈঠক হয়েছিল জয়ন্তীদেবীর বাড়িতে। সুভাষ জাগরণ মঞ্চের পদযাত্রায় হেঁটেছিলেন সবাই মিলেই। ফাইল প্রকাশের দাবিতে ধর্মতলা থেকে এলগিন রোড পর্যন্ত মিছিলেও হেঁটেছেন ওঁরা সবাই। কেন্দ্রের সেই ফাইল প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পাশে থেকেই দেখেছিলেন নেহরুর চিঠি। চিঠির বয়ান এমন যে, বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়েছে সে ব্যাপারে প্রমাণ নেহরুর হাতে নেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.