অর্ণব আইচ: পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সুপারিশেই স্কুলের গ্রুপ সিতে নিয়োগ করা হয়েছিল ৩৮১ জনকে। একেক জনের কাছ থেকে সুযোগ বুঝে আট থেকে ২০ লক্ষ পর্যন্ত টাকা নেওয়া হয়েছিল, এমনই অভিযোগ সিবিআইয়ের। এই টাকা কীভাবে, কাদের কাছে গিয়েছিল, সেই ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানতে মুখোমুখি জেরা হবে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়কে। এই মামলায় আগেই গ্রেপ্তার করা হয় পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রীয় স্কুল সার্ভিস কমিশনের বা এসএসসির প্রাক্তন কনভেনার শান্তিপ্রসাদ সিনহাকে।
নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষক দুর্নীতি মামলায় তাঁকে পাঁচ দিন আগে নিজেদের হেফাজতে নেয় সিবিআই। শনিবার তাঁকে ফের আলিপুরে বিশেষ সিবিআই আদালতে তোলা হয়। সিবিআইয়ের তদন্তকারী আধিকারিককে ডেকে অসন্তোষ প্রকাশ করেন বিচারক। তিনি প্রশ্ন করেন, যে শিক্ষকরা দুর্নীতির শিকার, তাঁদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে কি না। উত্তরে সিবিআই জানায়, সেটা হয়নি। অভিযুক্তদের প্রথমে জেরা করা হচ্ছে। শান্তিপ্রসাদবাবু তদন্তে অসহযোগিতা করছেন বলে দাবি করে তাঁকে হেফাজতে নেওয়ার আবেদন জানায় সিবিআই। বিচারক প্রশ্ন করেন, তদন্তে অভিযুক্তরা কীভাবে সহযোগিতা করবেন, তা দেখার দায়িত্ব সিবিআইয়ের। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা জানায়, শান্তিপ্রসাদবাবুকে জেরা করে আরও তথ্য জানার প্রয়োজন। তাঁকে ফের সিবিআই হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারক। অন্য মামলায় ধরা হলেও প্রয়োজনে শান্তিপ্রসাদবাবুকেও অন্য দু’জনের মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করতে পারে সিবিআই।
সিবিআইয়ের সূত্র জানিয়েছে, নিয়োগ দুর্নীতিতে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের যোগ স্পষ্ট। তাঁর নির্দেশেই তালিকা তৈরি হয়। তাতে বাদ যায় যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের নাম। আলাদাভাবে সুপারিশ করা হয় অযোগ্য প্রার্থীদের নাম, যাঁদের একেকজন বিপুল পরিমাণ টাকা দিয়েছিলেন। পাশ করা কত সংখ্যক প্রার্থীর নাম বাদ গিয়েছিল, এবার সিবিআই তা খুঁজে বার করছে। আপাতত সামনে ৩৮১ জনের নাম এলেও গোয়েন্দাদের ধারণা, এই সংখ্যাটি অনেক বেশি। সিবিআই এর অভিযোগ অনুযায়ী, নিয়োগের ক্ষেত্রে এসএসসি সুপারভাইজারি কমিটি তৈরি করেছিল তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশেই। অভিযোগ, ওই কমিটি আইনি প্রক্রিয়া মেনে তৈরি হয়নি। কমিটি ২০১৬ সাল থেকে এসএসসি নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০১৯ সালের মে মাসে প্যানেল বাতিল হয়ে যায়। এরপর গ্রুপ সি নিয়োগের পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি, অথবা অযোগ্য প্রার্থীদের নাম সুপারিশ করার ক্ষেত্রে শান্তিপ্রসাদ সিনহা একটি বড় ভূমিকা নেন।
সিবিআইয়ের অভিযোগ অনুযায়ী, এসএসসির এক প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও শান্তিপ্রসাদ সিনহা শূন্যপদগুলি পূরণের জন্যই সুপারিশপত্র তৈরি করেন। এভাবে ৩৮১ জনের ভুয়ো সুপারিশপত্র তৈরি হয়। এসএসসির তিন কর্তার নির্দেশেই অযোগ্য প্রার্থীদের নম্বর বাড়ানো হয় ও তাদের নাম প্রথমদিকে চলে যায়। ওই তিন কর্তার মধ্যে দু’জন শান্তিপ্রসাদ সিনহা ও এসএসসির প্রাক্তন সেক্রেটারি অশোক কুমার সাহাকে আগেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরপর শান্তিপ্রসাদ সিনহা ওই ভুয়ো সুপারিশপত্রগুলি তুলে দেন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে। কল্যাণময়বাবু পর্ষদের টেকনিক্যাল অফিসারকে নির্দেশ দেন ওই সুপারিশপত্রের ভিত্তিতে ভুয়ো নিয়োগপত্র তৈরি করতে। কিন্তু নিয়ম মেনে সুপারিশপত্রগুলি পর্ষদের নিয়োগ বিভাগে পাঠানো হয়নি। ফলে এই দুর্নীতির সঙ্গে আরও অনেকেই যুক্ত রয়েছে বলে অভিযোগ। এ ব্যাপারে আরও কয়েকজনকে জেরা করা হবে। এভাবেই ৩৮১ জনের ভুয়ো নিয়োগপত্র তৈরি হয়। তাঁরা চাকরিও পান।
এই ব্যাপারে আরও তথ্য জানতে এদিন আলাদাভাবে নিজাম প্যালেসে পার্থবাবু ও কল্যাণময়বাবুকে জেরা করা হয়। সিবিআই সূত্র জানিয়েছে, পার্থ চট্টোপাধ্যায় অস্বীকার করেন যে, তিনি সুপারিশপত্রগুলি পাঠিয়েছেন। যদিও সিবিআই তাঁকে জানায়, যে প্যাকেটগুলিতে সুপারিশপত্র পাঠানো হয়েছিল, সেগুলির উপরে সই ছিল পার্থবাবুর। যদি তিনি তা স্বীকার করতে চাননি। সূত্রের খবর, জেরার মুখে কল্যাণময়বাবু তির তুলেছেন পার্থবাবুর দিকেই। তাঁর দাবি, প্রাক্তন মন্ত্রীর নির্দেশে তিনি ওই সুপারিশপত্রগুলি নিয়েছেন। যদিও নিয়োগপত্রের ব্যাপারে তিনি সিবিআইকে কিছু জানাতে চাননি। কল্যাণময়বাবুর দাবি, নিয়োগপত্রে তাঁর নিজের সই নেই। যেগুলি রয়েছে, সেগুলি স্ক্যানড সই। সিবিআইয়ের দাবি, দুই অভিযুক্ত তদন্তে বিশেষ সহযোগিতা করছেন না।
এদিকে, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠদের দাবি, সিবিআই হেফাজতের প্রথম রাতেই ওষুধের অনিয়ম হয়েছে। জানা গিয়েছে, সারাদিনে ২৮টি ওষুধ তাঁকে খেতে হয়। কিন্তু কখন কোন ওষুধ দিতে হবে তা সিবিআইয়ের কাছে এখনও স্পষ্ট নয়। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রীর চিকিৎসায় একটি বিশেষ যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। যিনি সেই মেশিনটি সেট করেন, তিনিও শুক্রবার অনুপস্থিত ছিলেন বলেই দাবি। ফলে বেকায়দায় পড়তে হয়েছিল প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীকে। রাতে ভাল ঘুম হয়নি তাঁর। স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত পার্থ। ফলে রাতে একাধিকবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তাঁর। ভোরের দিকে কিছুটা ঘুমাতে পেরেছেন পোড় খাওয়া এই রাজনীতিবিদ, এমনই খবর তাঁর ঘনিষ্ঠদের সূত্রে। তবে সাধারণভাবে খাওয়াদাওয়া করছেন তিনি। এইমসের ডায়েট চার্ট মেনেই ক্যান্টিনে খাবার তৈরি করে তাঁকে দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে সিবিআই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.