অর্ণব আইচ: নাম ভাঁড়িয়ে তিনটি ভুয়ো আধার কার্ডের কপি জমা দিয়ে কলকাতার অন্তত আটটি হোটেলে গা-ঢাকা দিয়ে ছিল বেঙ্গালুরু বিস্ফোরণের মাথা দুই জঙ্গি। এমনকী, প্রমাণ লোপাটের জন্য খিদিরপুরের একটি হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় রেজিস্টার খাতার পাতা ছিঁড়ে নেয় দুই জঙ্গি আবদুল মতিন আহমেদ তাহা ও মুসাভির হুসেন শাজিব। এর পর আবদুল মতিন সেই রেজিস্টারের ছেঁড়া পাতা নিজের পকেটে রেখে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসে। ১৮ দিন ধরে কলকাতার হোটেলে গা-ঢাকা দিয়ে থাকার পর তারা কোলাঘাট হয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের দিকে পাড়ি দেয়। গত ৫ এপ্রিল থেকে এই দুই জঙ্গির সন্ধানে কলকাতার প্রায় ১৫টি হোটেলে হানা দেয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-র টিম। হোটেলগুলির কর্মচারীরা জানতেন, তারা সাইবার অপরাধী। জঙ্গি গ্রেপ্তারির খবর পেয়ে হতবাক প্রত্যেকেই।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, আইএস জঙ্গি আবদুল মতিন আহমেদ তাহা নিজেকে কোনও হোটেলে ভিগ্নেশ বি ডি, আবার কোনও হোটেলে সে আনমোল কুলকার্নি বলে পরিচয় দেয়। ভিগ্নেশ হিসাবে কর্নাটকের বাসিন্দা বলে পরিচয় দেয়। আবার আনমোল কুলকার্নি বলে যখন পরিচয় দিত, তার বাবার নাম বলা হত উদয় কুলকার্নি, ঠিকানা কর্নাটকের কাটাবুরাগির। সঙ্গী মুসাভির হুসেন শাজিব নিজের নাম ভাঁড়িয়ে পরিচয় দেয় ইউশা শাহনওয়াজ প্যাটেল বলে। বাবার নাম হারুণ প্যাটেল। তার ভুয়া ঠিকানা মহারাষ্ট্রের থানের পালঘরের কাচেরি রোডের মহাবীর ভবন। কলকাতায় আসার কারণ সম্পর্কে কখনও বলত পর্যটন, কখনও বা শুধু ‘অফিসিয়াল’।
বেঙ্গালুরুর কাফেতে বিস্ফোরণের পর তারা চেন্নাইয়ে পালায়। সেখান থেকে কখনও বাস, কখনও ট্রেন, অর্থাৎ ‘কাটা রুটে’ গত ১০ মার্চ এসে পৌঁছয় হাওড়া স্টেশনে। একটি ট্যাক্সিচালককে হোটেলে নিয়ে যেতে বলে। তিনি লেনিন সরণির একটি হোটেলে নিয়ে আসেন। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ হোটেলের একতলায় ৫৬০ টাকা দামের একটি ঘর তারা ভাড়া নেয়। সেদিনই বিকেল পাঁচটায় ওই হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে যায় তারা। রেজিস্টার খাতায় লেখে শিলিগুড়ি যাচ্ছে। ধর্মতলা অঞ্চলেই একটি হোটেলে থাকে দুরাত। ১২ মার্চ দুপুরে এস এন ব্যানার্জি রোডের একটি হোটেলে দুপুরে এসে ৯০০ টাকার ঘরে থাকে।
চেক আউট করে ১৩ মার্চ দুপুরে। বিকেল পর্যন্ত ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে পৌঁছয় লেনিন সরণির অন্য একটি হোটেলে। রেজিস্টার খাতায় ইউশা শাহনওয়াজ প্যাটেল ও আনমোল কুলকার্নি পরিচয় দিয়ে জানায়, তারা দার্জিলিং থেকে এসেছে, যাবে চেন্নাই। ৭০০ টাকার ঘরে ১৪ মার্চ দুপুর বারোটা পর্যন্ত থেকে চেক আউট করে। সেদিন থেকে ২১ মার্চ তারা শিলিগুড়ি-সহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ছিল বলে গোয়েন্দাদের সন্দেহ। আবার কলকাতাতেও তারা ছিল কি না, তা জানতে চলছে জেরা।
গত ২১ মার্চ দুপুর একটায় অটোয় করে এসে ওই দুই জঙ্গি খিদিরপুরের একটি হোটেলে চেক ইন করে। তারা হাজার টাকার ঘর ভাড়া নেয়। নিজেরাই বলে, পরিচয়পত্র ফোটোকপি করে এনে দেবে। কিন্তু সেই কপি তারা দেয়নি। উল্টে ২২ মার্চ সন্ধ্যার পর রেজিস্টার খাতার পাতা ছিঁড়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। সেই দৃশ্য উঠেছে সিসিটিভিতেও। এর পর ২৫ মার্চ পর্যন্ত ওয়াটগঞ্জ ও একবালপুর এলাকার আরও দুটি হোটেলে রাত কাটায় তারা। ২৫ মার্চ দুপুরে একবালপুর থানার অদূরে একটি হোটেলে হাজার টাকার ঘর ভাড়া নেয় তারা। ২৮ মার্চ পর্যন্ত থাকার জন্য দুদফায় তিন হাজার টাকা ভাড়া দেয়। কলকাতার ওই হোটেলগুলিতে তারা না খেয়ে বাইরের রেস্তরাঁয় খেত। কোনও হোটেল কর্মীর সঙ্গে বেশি কথা বলত না। ২৮ মার্চ তারা প্রথমে এগরা যায়। সেখানে আইএস-এর এক স্লিপার সেলের সদস্যর বাড়িতে থাকার পর পৌঁছয় কাঁথিতে। সেখান থেকে দিঘায়। গোয়েন্দাদের মতে, দিঘায় একাধিক হোটেলে গা-ঢাকা দেওয়ার পর এসে পৌঁছয় নিউ দিঘায়। সেখান থেকেই তাদের গ্রেপ্তার করে এনআইএ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.