সুচেতা সেনগুপ্ত: করোনা জ্বরে কম্পমান বিশ্বে এখন প্রায় অমৃতসম – হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন (Hydroxychloroquin), যা করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় বিশেষ সহায়ক হয়ে উঠছে। এমনটাই দাবি চিকিৎসকদের। এই সূত্রে ভারত-আমেরিকার পথ্যযুদ্ধও শুরু হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। করোনা মুক্তির রাস্তা হিসেবে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের চাহিদা যখন তুঙ্গে, তখনই নজর কাড়ল সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া আরও এক খবর। আমাদের বঙ্গের ঐতিহ্যবাহী ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা বেঙ্গল কেমিক্যালস নাকি এর পথপ্রদর্শক। এখানেই নাকি তৈরি হয় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। খবর কতটা সত্য, তা সরেজমিনে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল, বেঙ্গল কেমিক্যালসে এই বিশেষ ওষুধটি তৈরি হয় না। জানালেন সংস্থারই অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক তথা কেমিস্ট ড. প্রদীপ চক্রবর্তী।
এই খবর সম্পর্কে সামাজিক মাধ্যমে যে যে তথ্য মিলছে, তা কিছুটা বিভ্রান্তিকর। সেই বিভ্রান্তি কাটাতেই আমরা কথা বলেছিলাম প্রদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালসের কোয়ালিটি কন্ট্রোল বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত। বেঙ্গল কেমিক্যালসে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন তৈরি হয় না, সামাজিক মাধ্যমের খবর ঠিক নয়, এ কথা জানানোর পরও অবশ্য তিনি আশার কথাই শোনালেন। কুইনাইনের অন্য দুটি যৌগ – ক্লোরোকুইন ফসফেট (Chloroquin Phosphate) ও ক্লোরোকুইন সালফেটের (Chloroquin Sulphate) ট্যাবলেট তৈরি হয় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থায়, যা ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসেবে বহু যুগ ধরে ভারতবাসীর রোগ নিরাময় করেছে। এই সালফেট বা ফসফেট যৌগ সহজে দ্রাব্য হওয়ায় তা মানুষের শরীরে দ্রুত কাজ শুরু করে। তুলনায় হাইড্রক্সিক্লোরাকুইন শরীরে কার্যকর হতে কিছুটা সময় নেয়। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় যদি হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন সহায়ক হয়, তাহলে এই দুই ওষুধও কার্যকর হবে বলে জানাচ্ছেন ড. প্রদীপ চক্রবর্তী। সেদিক থেকে বেঙ্গল কেমিক্যালসের দিকেই এই মুহূর্তে তাকিয়ে সকলে।
আরও একটি বিষয় এক্ষেত্রে পরিষ্কার করা দরকার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারতের কাছ থেকে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন চেয়ে কার্যত হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। তারপরই ২৪টি ওষুধের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় ভারত। এই খবরে আবার আমজনতার মনে সংশয় তৈরি হয়েছে এই ভেবে যে, আমেরিকাকে ওষুধ দিলে দেশবাসীর জন্য ওষুধের ঘাটতি পড়তে পারে। এই উদ্বেগও অনর্থক। কারণ, বেঙ্গল কেমিক্যালসে প্রস্তুত ক্লোরোকুইন ফসফেট এবং সালফেটের ট্যাবলেট হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের মতই কার্যকর এক্ষেত্রে।
এরপরও অবশ্য ভাবার আছে। করোনা ভাইরাসের মহামারির বিরুদ্ধে লড়ছে গোটা বিশ্ব। এই পরিস্থিতিতে শুধু আমেরিকাকে নয়, সার্কভুক্ত যে কোনও দেশকেই ওষুধ দিয়ে সাহায্য করতে হচ্ছে ভারতকে। ম্যালেরিয়ার নিরাময়কারী কুইনাইনের উৎস এই বাংলা, দার্জিলিংয়ের মংপু। এখানকার সিঙ্কোনা গাছের ছাল কাজে লাগিয়ে গবেষণাগারে কুইনাইনের যৌগ তৈরি করা হয়। সেই যৌগ থেকে প্রস্তুত হয় ট্যাবলেট। বর্তমান পরিস্থিতিতে দরকার প্রচুর পরিমাণ ওষুধ।
বেঙ্গল কেমিক্যালস সেই কাজে যুগ যুগ ধরে এত সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, তাকে ক্রমশ বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দিয়েছে কেন্দ্র। তাতে সংস্থার অবস্থা খারাপ বই ভালো হয়নি। গত ১০, ১২ বছর ধরে উৎপাদনের হার কমেছে, নিয়োগ প্রায় শূন্য। ধুঁকছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এই সংকটের সময় বেঙ্গল কেমিক্যালসকে পুনরুজ্জীবিত করে তার উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির পথে হাঁটলে মিটে যেতে পারে সমস্যা। তাতে দেশের মানুষ প্রয়োজনীয় ওষুধ পেয়ে করোনা মোকাবিলায় সফল হয়ে উঠতে পারবেন। দ্রুতই করোনামুক্ত হতে পারবে ভারত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.