অর্ণব আইচ: মানুষটা পড়ে রইল এটিএমের সামনে। সবাই দেখল। কেউ তাকে তুলল না। যদি কেউ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেত, আজ এই দিনটা আর দেখতে হত না। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সীমা। মুছলেন চোখের কোনায় আসা জল। সামনে টেবিলের উপর স্বামী কল্লোল রায়চৌধুরির ছবি।
[আরও পড়ুন: পোস্তা সেতুর স্মৃতি আর ইস্যু নয়, তবে এখনও কাটেনি আতঙ্ক]
২০১৬ সালের ৩ ডিসেম্বরের দৃশ্যটা হয়তো অনেকের মনে আছে। সিঁড়িতে মাথা। জামা খোলা। লোকটি শুয়ে আছেন মাটিতে। পাশেই একটি এটিএমের সামনে লাইন দিয়ে বহু মানুষ। নোটবন্দির পরের ঘটনা। যখন পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, তখন মৃত্যু হয়েছে তাঁর। নোটবন্দি উচিৎ না অনুচিত, সেই প্রশ্ন ছাপিয়ে এখন উঠে এসেছে মানবিকতা-অমানবিকতার প্রশ্ন। আড়াই বছর পরও কল্লোল রায়চৌধুরির মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না আদর্শনগর। দক্ষিণ কলকাতা লোকসভার অন্তর্গত বেহালা পশ্চিমের আদর্শনগরের পুরনো বাসিন্দা রায়চৌধুরি পরিবার। বেহালা চৌরাস্তা-আদর্শনগর রুটের অটোস্ট্যান্ড থেকে একটু এগিয়ে গেলেই আদর্শনগর বাজার। খাবারের দোকান, মুদির দোকান পেরিয়ে কয়েক পা এগোলেই চোখে পড়ে একতলা বাড়িটি। সেখানে এখন থাকেন কল্লোলের স্ত্রী সীমা রায়চৌধুরি ও ছেলে শুভজিৎ।
সীমা জানালেন, ভূমি দপ্তরের কর্মী কল্লোলের পোস্টিং ছিল কোচবিহারের চ্যাংড়াবান্ধায়। নোটবন্দির পর নগদ টাকা ছিল না কল্লোলের হাতে। হুগলির ব্যান্ডেল স্টেশনে নেমে একটি এটিএম কাউন্টারে টাকা তুলতে গিয়েছিলেন। সেখানেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। যাঁরা টাকা তুলতে ব্যস্ত ছিলেন, তাঁরা কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। কল্লোলের মৃত্যুর পর রাজ্য সরকার সীমার চাকরির ব্যবস্থা করে। বেহালা চৌরাস্তায় ভূমি দপ্তরের অফিসে পোস্টিং পেয়েছেন তিনি। রায়চৌধুরিদের বাড়ির অদূরেই কল্লোলের ছোটবেলার বন্ধু কার্তিকবাবুর দোকান। তিনি বললেন, “কল্লোলের মতো হাসিখুশি ছেলে কম পাওয়া যায়। কলকাতায় আসার পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে খুব মজা করত। যে কোনও অনুষ্ঠানে ওকে ছাড়া চলত না। কল্লোলের মৃত্যুর খবর পেয়ে পাড়ার বন্ধুরা মিলে বেহালা থেকে ছুটে যাই ব্যান্ডেলে। মর্গ থেকে দেহ বের করার সময় কেউ চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। কল্লোলের মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছে না।” কল্লোলের অন্য এক বন্ধু বলেন, “নোটবন্দির ফলে অনেকের অসুবিধা হয়েছে। অনেকে আবার বলছেন নোটবন্দিতে ভালই হয়েছে, ধাক্কা খেয়েছে জালনোটের কারবার। ভাল মন্দ জানি না, কল্লোলের দেহ বেহালায় নিয়ে আসার সময় শুধু মনে হচ্ছিল মানুষ কীভাবে এত অমানবিক হয়।”
কল্লোলের স্ত্রী সীমা বলেন, “নোটবন্দির জন্যই মৃত্যু হয়েছে আমার স্বামীর। জানেন, নোটবন্দির পর তাঁর কী অবস্থা হয়েছিল? হাতে নগদ টাকা নেই। হয় এটিএম খারাপ, না হয় এটিএমের সামনে বড় লাইন। চালের দোকানে ধার, মুদির দোকানে ধার। তার উপর বাড়িতে রাখা পুরনো পাঁচশো আর হাজার টাকা পালটানোও বড় সমস্যা। সারাদিন সারারাত টেনশনে ভুগতেন মানুষটা। ব্যান্ডেল স্টেশনে নেমেই ফুটব্রিজ পেরিয়ে এটিএমের দিকে দৌড়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বাবার মৃত্যুতে শক পেয়েছে ছেলেও।” পুরনো পাড়া আদর্শনগর এখনও ভোলেনি তাদেরই ভূমি সন্তান কল্লোলকে। মানতে পারেনি তাঁর মৃত্যু। এখনও যাতায়াতের পথে বহু মানুষ তাকান কল্লোলের বাড়ির দিকে, যেখানে কল্লোল আর নেই।
[আরও পড়ুন: স্কুলের ছাদে ‘মদের আসর’! মত্ত অবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটালেন জওয়ান]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.