ছবি: পিন্টু প্রধান
বিশাখা পাল: ঋতু পরিবর্তনের নিয়ম মেনে এখন আশ্বিন আসতে ঢের দেরি। ক্যালেন্ডারের পাতায় এখন বছরই ঘোরেনি। চৈত্র শেষ করে নতুন বছরের বৈশাখ আসতে আরও দিনকয়েকের অপেক্ষা। কিন্তু কুমোরটুলি পাড়ায় এই সময় থেকেই শুরু হয়ে যায় তোড়জোড়। মহিষাসুরমর্দিনী ক্রমশ রূপ পেতে থাকেন শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায়। কোনও কোনও শিল্পীর ঘরে আবার মৃন্ময়ী উমা সেজে উঠতে থাকেন অলংকারে। ঠাকুর গড়া শেষ করে প্রতীক্ষা শুরু হয় ‘ঠাকুর ডেলিভারির’। কারণ, এই সময় উমা যে বিদেশ পাড়ি দেন। আমেরিকা, কানাডা, লন্ডন… কোথায় না যায় কুমোরপাড়ার দুর্গা। কিন্তু এ বছর ব্যতিক্রম। এ বছর কুমোরটুলি পাড়ায় নেই কোনও তাড়াহুড়ো। গোটা পাড়াই যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। করোনা যেন প্রাণ কেড়ে নিয়েছে গোটা কুমোরটুলির।
এই নিয়েই কথা হচ্ছিল শিল্পী কৌশিক ঘোষের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, বিদেশ থেকে বায়না আসে অনেক আগেই। পাড়ার অন্য শিল্পীদের মতো তিনিও বরাত পেয়েছিলেন এ বছর। এসেছিল অ্যাডভান্সও। মনের আনন্দে শুরু করেছিলেন মূর্তি গড়ার কাজ। কিন্তু মাঝপথে সব থমকে যায়। করাল করোনা গ্রাস করে তাঁদের জীবিকা। আমেরিকায় হু হু করে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা ভাইরাস। ইটালি, স্পেনের অবস্থাও শোচনীয়। টেলিভিশনে এইসব খবর দেখতে দেখতেই তাঁরা আশঙ্কা করেছিলেন এবার হয়তো কোপ পড়বে পুজোয়। জল যেন সেদিকেই গড়াচ্ছে। কিন্তু একটা স্বস্তি ছিল। এদেশে তো থাবা বসায়নি প্রাণঘাতী এই ভাইরাস। অতএব কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন তাঁরা। কোনও অসুবিধা হবে না। তারপর ওদেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই বিদেশ যাবে প্রতিমা। কিন্তু আশা আর বাস্তবায়িত হল না।
করোনার থাবা পড়ল ভারতে। লেজের ঝাপটা লাগল বাংলাতেও। রাজ্যের একাধিক জায়গা থেকে সন্ধান মিলল করোনা রোগীর। সংক্রমণ রুখতে জারি করা হল লকডাউন। আর তার প্রভাব এসে পড়ল কুমোরটুলিতে। বন্ধ হল কাজ। কিন্তু যেসব মূর্তি বিদেশ পাড়ি দেওয়ার কথা সেগুলো তো শেষের পথে? সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী? কৌশিকবাবু বলছিলেন, “কী আর হবে? টুক টুক করে চলছে কাজ। কিছু প্রতিমার কাজ তো শেষ। সেগুলো তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে। আমেরিকা, কানাডা, সিডনির প্রতিমা রয়েছে আমার কাছে। কাজ শেষ। কিন্তু কবে যাবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।” করোনা আর লকডাউন তাঁদের শাঁখের করাতের মতো দু’পাশ থেকে চেপে ধরেছে। এদেশে যদি লকডাউন উঠেও যায়, বিদেশে কবে উঠবে, তার নিশ্চয়তা নেই। পশ্চিমের দেশগুলির বর্তমানে যা পরিস্থিতি, কবে যে তারা উঠে দাঁড়াবে, তা কেউ জানে না। কৌশিকবাবু বলছিলেন, “ওখানে তো পরিস্থিতি আরও খারাপ, কী হবে কিছুই বুঝতে পারছি না।”
এ তো গেল একদিকের কথা। এর পাশাপাশি আরও একটি ভাবনা ভাবাচ্ছে কুমোরটুলির শিল্পীদের। তাঁদের চিন্তা, এই প্রতিমাগুলো না নিয়ে গেলে পরের প্রতিমা বানাবেন কী করে? স্থান সংকুলানই হবে কোথা থেকে? পরিস্থিতি যেভাবে খারাপ থেকে অতি খারাপের দিকে এগোচ্ছে, তাতে প্রতিমার বিদেশপাড়ি এখন বিশ বাঁও জলে। বিদেশ থেকেও কোনওরকম আশার বাণীও শোনাতে পারছেন না পুজো উদ্যোক্তারা। তার উপর আর্থিক সমস্যা তো রয়েছেই। বিদেশ থেকে বরাত যখন এসেছিল তখন সঙ্গে এসেছিল অ্যাডভান্স। বাকি টাকা দেওয়ার কথা ছিল ‘ঠাকুর ডেলিভারি’র পর। কিন্তু এখন মূর্তি কবে বিদেশ যাবে, তার কোনও ঠিক নেই। তাই বাকি টাকা পাওয়ার আশাও ছেড়ে দিতে হয়েছে ভাগ্যের হাতে। সব মিলিয়ে কুমোরপাড়ার ভবিষ্যৎ এখন বিরাট প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। খরা কবে কাটবে, জানা নেই। ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে অন্নপূর্ণা পুজো। কুমোরপাড়া থেকে হাতে গোনা কয়েকটি অন্নপূর্ণা মূর্তি বেরিয়েছে। বাকি সব পড়ে রয়েছে শিল্পীর ঘরে। এবার দুর্গার ক্ষেত্রেও তার পুনরাবৃত্তি হবে না তো? কপালে ভাঁজ শিল্পীদের। দিন যত যাচ্ছে, কুমোরটুলির মাথায় যেন ঘনীভূত হচ্ছে আশঙ্কার কালো মেঘ।
ছবি ও ভিডিও- পিন্টু প্রধান
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.