সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ‘আবার এসে গিয়েছি,’ মন্দ্র স্বরটা গমগম করে বেজে উঠতেই হাততালিতে ফেটে পড়ল ভরা নেতাজি ইন্ডোর৷ যেন এই মুহূর্তটারই অপেক্ষা ছিল৷ গত কয়েক বছর ধরে এ যেন বাংলা চলচ্চিত্র উৎসবের রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তিনি আসবেন, বলবেন আর জয় করবেন৷ এবছরও তার ব্যতিক্রম হল৷ তারা ভরা মঞ্চে ঠিক ‘বিগ’ হয়ে উঠলের ‘কলকাতার জামাইবাবু’ অমিতাভ বচ্চন৷
মঞ্চে উপস্থিত অন্য তারকারাও বোধহয় জানতেন, কলকাতাবাসী কীসের অপেক্ষায়৷ তাঁর কোর্টেই তাই বল ঠেলে দিয়েছিলেন ‘ধন্যি মেয়ে’৷ বললেন, “আমি তো ঘরের মেয়ে৷ সবসময় আমাকে শুনতে পাবেন, বরং জামাইবাবুর কথা শুনুন৷” সঞ্জয় দত্ত শোনালেন, কলকাতা তাঁর মায়ের জন্মভূমি৷ একটু যেন নস্ট্যালজিক ‘মুন্নাভাই’৷ কাজলও প্রথমবার চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে এসে একলাইন বাংলা বলে হাততালি কুড়িয়েছিলেন৷ এদিকে এবছর ছিল বাংলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরের কথা রাখার পালা৷ তা কথা রাখলেন শাহরুখ খান৷ হোমওয়ার্ক যে করে এসেছিলেন তা বোঝাই গেল৷ বাংলাতেই বললেন, “বাংলায় আসব আর বাংলায় কথা বলব না তা কখনও হয়৷” বাংলা চলচ্চিত্র উৎসবকে সর্বজনীন করে তোলার যে পরিকল্পনা নিয়েছে মমতা সরকার, সে কথা উঠে এল তাঁর ছোট্ট বক্তৃতায়৷ স্বভাবসিদ্ধ হিউমারে তিনি আসর মাতালেন৷
তবে এ সবই ছিল নান্দীমুখ৷ অপেক্ষা ছিল তিনি কী বলবেন তা নিয়ে৷ আর তাই লম্বা দীর্ঘ চেহারাটা মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ানো মাত্র নড়েচড়ে বসলেন সকলে৷ গতবছর হাসতে হাসতে বলেছিলেন, আর যেন তাঁকে নিমন্ত্রণ না করা হয়৷ কেননা সিনেমা নিয়ে তাঁর বলার মতো কথা ফুরিয়েছে৷ কিন্তু কে বলল কথা ফুরিয়েছে! ভারতীয় সিনেমায় নারীর অবস্থান নিয়ে যখন তিনি বলতে শুরু করলেন তখন মন্ত্রমুগ্ধ গোটা স্টেডিয়াম৷ ‘অচ্ছুতকন্যা’ থেকে ‘সুজাতা’ হয়ে ‘পিঙ্ক’ পর্যন্ত সিনে পরিক্রমায় তিনি প্রায় গবেষক ছাত্রের মতো করে তুলে ধরলেন, কীভাবে ভারতের সমাজব্যবস্থার সঙ্গে বদলেছে সিনেমায় নারী চরিত্ররা৷ যে ভারতীয় সিনেমায় নারী মানেই হয় প্রেমিকা নয় মা, নয় স্ত্রী- সেখান থেকে একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট মহিলা হয়ে ওঠার লড়াই কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে সেলুলয়েডে উঠে এল তারই বিবরণী৷ সেই মুহূর্তে সকলেই মন্ত্রমুগ্ধ৷ এ যেন এক ট্রেণ্ড সেট করে ফেলেছেন বিগ বি৷ সেই যেবার প্রথম হীরালাল সেনের নাম তুলে এনেছিলেন, তারপর থেকে, তাঁর বক্তৃতাই মাত্রই সিনেসমাজের মুগ্ধ পাঠ৷ আর শাহরুখ-কাজল-পরিণীতিদের দেখতে আসা কয়েক হাজার মানুষ তুমুল হর্ষধ্বনি থামিয়ে বাধ্য ছাত্র হয়েই শুনল তাঁর কথা৷ সিনেমার মঞ্চ থেকেই নারীশক্তির মশালটা যেন জ্বালিয়ে দিলেন তিনি৷
এলিট ক্লাসের ঘেরাটোপ থেকে চলচ্চিত্র উৎসবকে সাধারণ মানুষের দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের৷ বিগত কয়েক বছরের উৎসব নিয়ে সমালোচনা হয়েছে অনেক৷ কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, চলচ্চিত্র উৎসবকে ঘিরে সাধারণ মানুষ যেভাবে আগ্রহী হয়েছেন তার নমুনা অন্তত পূর্বতন আমলে ছিল না৷ এখানেই সিনেমা সকলের হয়ে উঠেছে৷ সেই সার্বজনীনতার ছোঁয়া নিয়ে জ্বলে উঠল ২২তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী প্রদীপ৷ ইতিহাস তৈরি করে এবারই প্রথম উৎসব শুরু হচ্ছে বাংলা ছবি দিয়ে৷ ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত উৎসবের আঙিনা মুখরিত থাকবে সিনেমার আলোছায়ায়৷ আর তার ভিতরই কোথাও থেকে গেল নারীশক্তির প্রজ্জ্বলিত মশালটি৷ বিগ বি ‘মা’ ফ্লাইওভার থেকে ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের কথা উল্লেখ করলেন৷এও তো নারীশক্তির এক স্বীকৃতিই৷ কলকাতার চলচ্চিত্র উৎসবের ইতিহাসও নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতে স্বীকার করবে, কীভাবে নারীশক্তিই বদলে দিল তার অভিমুখ৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.