আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়: অমলকুমার মুখোপাধ্যায় ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে (প্রেসিডেন্সি তখনও বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠেনি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান। পরে তিনি সেই কলেজের অধ্যক্ষও হয়েছিলেন, কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা। আমি ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত বিএ ক্লাসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ওঁর প্রত্যক্ষ ছাত্র, সে-কথাই বলব।
বীরভূমের ছেলে অমলবাবু (প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় ওঁর বন্ধু ছিলেন) লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে পিএইচডি করে কলকাতায় ফিরে এসে তরুণ বয়সেই প্রেসিডেন্সিতে যোগ দেন। তখনও বিলেতফেরত মেধাবী ছাত্ররা কলকাতায় ফিরতেন, ফেরার সুযোগ তৈরি হত, সগৌরবে তাঁরা নানা নামী প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে গৃহীত হতেন। অমলবাবু সসম্মানে প্রেসিডেন্সিতে অধ্যাপক হয়েছিলেন, তাঁর চারপাশে গ্ল্যামারের একটি অদৃশ্য বলয় ছিল। কিন্তু এতে তাঁর জীবনযাপনে কোনও কৃত্রিম দেওয়াল তৈরি হয়নি। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের মহম্মদ আলি পার্ক বাসস্টপে মিনিবাস থেকে নেমে, হেঁটে হিন্দু হস্টেলের পাশ দিয়ে প্যারীচরণ সরকার স্ট্রিট হয়ে কলেজে ঢুকতেন – এ দৃশ্য আমাদের কাছে পরিচিত ছিল।
বিলেতের প্রশিক্ষণ নিয়ে অমলবাবুর একটু বুঝি গর্ব ছিল। আধুনিক ভাববাদী বিলিতি দার্শনিক টি এইচ গ্রিন ছিলেন তাঁর গবেষণার বিষয়। গবেষণার শুরুতেই সুপারভাইজার কীভাবে তাঁকে দিয়ে মাসাধিক কালের পরিশ্রমে গ্রিনের উপর লেখা সকল বইপত্রের আদ্যন্ত তালিকা (বিবলিওগ্রাফি) করিয়েছিলেন – ক্লাসে একদিন সে গল্প করেছিলেন।
টি এইচ গ্রিন নিয়ে গবেষণা করেছিলেন মানে কিন্তু ঠিক দর্শনশাস্ত্রের অঙ্গীভূত ছিল না অমলবাবুর গবেষণা। বরঞ্চ দর্শনশাস্ত্রের রাষ্ট্রতত্ত্ব নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল। আরও সোজাসুজি বলা যায়, তাঁর বিষয় ছিল ‘এথিক্স অব ওবিডিয়েন্স’। আমরা যে রাষ্ট্রকে আনুগত্য দিই, তার পিছনে ঠিক কোন নীতিবোধ কাজ করে, গ্রিনকে ঘিরে সেটাই ছিল অমলবাবুর গবেষণার প্রশ্ন।
এক অর্থে, সমগ্র পশ্চিমি রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রীয় প্রশ্ন এটাই : নাগরিক কেন রাষ্ট্রকে আনুগত্য দেবে? রাষ্ট্র আদর্শ প্রতিষ্ঠান, তাই? রাষ্ট্রের খুব প্রতাপ আছে, তাই? রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকদের এক ধরনের দেওয়া-নেওয়ার চুক্তি আছে, তাই? প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ও অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে আধুনিক ইউরোপীয় দার্শনিক হেগেল ও তাঁর উত্তরসূরি গ্রিন পর্যন্ত সকলেরই জিজ্ঞাসার কেন্দ্রীয় বিষয় তো এটাই। অমলবাবু আমাদের এই সবই পড়াতেন, সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে ও সাবলীল আত্মবিশ্বাসে। এসব নিয়ে তাঁর প্রামাণ্য বইও আছে।
ইউরোপীয় ভাববাদী দর্শনে যে কেন্দ্রীয় কিছু তত্ত্ব বা অনুমান শতকের পর শতক ধরে একটা পরম্পরায় বাহিত হয়ে চলেছে, তা বোঝানোর জন্য অমলবাবু সহসা চলিত স্তরেও নেমে আসতে পারতেন। মনে আছে, হেগেল পড়াতে পড়াতে অট্টহাস্যে ভেঙে পড়ে বলেছিলেন – “হেগেল আসলে প্লেটোকে টুকে মেরে দিয়েছেন”। প্লেটোর ভাববাদ ও হেগেলের ভাববাদ যে দু’হাজার বছরের ব্যবধান ঘুচিয়ে আসলে কিছু কথা একই ভাবে বলেছে – তা মুহূর্তে আমাদের কাছে জলবৎ পরিষ্কার হয়েছিল।
দূরবর্তী ইউরোপীয় রাষ্ট্রদর্শনকে লহমায় আমাদেরই চারপাশের রাস্তাঘাটে দেখবার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল অমলবাবুর। ক্লাসে পড়াচ্ছিলেন আধুনিক বুর্জোয়া ইউরোপের একটি জনপ্রিয় ধারণা – এনলাইটেন্ড সেলফ-ইন্টারেস্ট বা আলোকিত স্বার্থচিন্তা। আপন স্বার্থচিন্তাকে বৃহতের স্বার্থচিন্তায় যুক্ত করে পুঁজি কীভাবে নিজের একটা বৈধ ও উদার কাঠামো গড়ে তুলতে চায় – এইসব আলোচনা হচ্ছিল। সহসা অমলবাবু বললেন : “বড়বাজারে ব্যবসায়ীরা দোকানে ‘শুভ লাভ’ লেখে দেখেছ”? লাভকে শুভ জ্ঞান করার মধ্যেই আছে পুঁজির বৃহৎ হওয়ার আয়াস ও আত্মবিশ্বাস! এ-কথা শোনার পর পঁয়তাল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হল। আজও কোথাও ‘শুভ লাভ’ লেখা থাকতে দেখলে সেই ক্লাসের কথা মনে পড়ে।
ব্যক্তিগত বিশ্বাসে, অমলবাবু মার্কসবাদী ছিলেন। ইউরোপীয় ভাববাদী দর্শনের বিপরীতে মার্কসের দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ কী নতুন কথা বলেছিল, তা আমরা তাঁরই প্রযত্নে শিখেছিলাম। বিশ্বব্যাপী কোল্ড ওয়ারের পরিপ্রেক্ষিতে তখন পাঠক্রমেও ভাববাদের সঙ্গে যুঝত বস্তুবাদ। একদিকে পড়া হত হেগেল-গ্রিন-ওয়েবারদের, অন্যদিকে চর্চা হত মার্কস-লেনিনের। অমলবাবু উভয় ধারাতেই প্রাঞ্জল ও গভীর ছিলেন।
ওই প্রাঞ্জলতা ও গভীরতা পরবর্তীকালে অন্য কোথাও পাইনি। আইএএস প্রশিক্ষণের সময় মুসৌরিতে লালবাহাদুর শাস্ত্রী ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ভারতের নামী-দামী নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্রদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে গিয়ে বুঝেছি – বাস্তবিকই প্রেসিডেন্সিতে অমলবাবুর মতো মাস্টারমশায়রা যেভাবে আমাদের তৈরি করে দিতেন, তেমনটি বোধহয় আর কোথাও তখন ছিল না।
অমলবাবু আমার আইএএস হওয়া পছন্দ করেছিলেন বলে মনে হয় না। তিনি বোধহয় তখন চেয়েছিলেন, তাঁর উৎসুক ছাত্ররা পড়াশোনার জগতেই থাক (পরে অবশ্য তিনি প্রেসিডেন্সিতে একটি আইএএস প্রস্তুতির চর্চাকেন্দ্র খুলেছিলেন!)। ইউপিএসসি পরীক্ষায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পেপারে উত্তর লেখার সময় একলব্যের মতো তাঁকেই যে স্মরণ করেছি, সে-কথা তাঁকে কখনও বলা হয়নি। কিন্তু প্রৌঢ় অধ্যাপক আমাদের স্বামী-স্ত্রীর প্রতি কালক্রমে আরও নিবিড়ভাবে স্নেহশীল হয়েছেন। তাঁর ছাত্রী অ্যাকাডেমিয়ায় থেকে যায় এবং তাঁর ছাত্র প্রশাসনে গিয়েও তাঁর পাঠ পুরো ভোলেনি – এটা হয়তো তাঁকে ধীরে তৃপ্ত করে।
প্রণাম নেবেন স্যর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.