রাহুল রায়: প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে বা মেয়ে নিজের ইচ্ছেয় বাড়ি ছাড়তেই পারে। কিন্তু যে মা তাঁকে দশ মাস-দশ দিন গর্ভে ধারণ করেছেন, স্নেহচ্ছায়া দিয়ে বড় করেছেন, সব বিপদ থেকে আগলে রেখেছেন, তাঁর সঙ্গে সন্তানের দুর্ব্যবহার কখনওই কাম্য নয়, সে পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন। ঘরছাড়া এক সমকামী তরুণীর সন্ধান সংক্রান্ত মামলায় এমনই পর্যবেক্ষণ কলকাতা হাই কোর্টের (Calcutta High Court)।
সুদর্শনা ও মিষ্টভাষী মেয়েটি আদতে সমকামী। তার ‘অন্যরকম’ হাবভাব, আচার-আচরণ হামেশাই মানুষের নজরে পড়ে, পাড়াপড়শি- আত্মীয়স্বজনের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। বাড়ির লোকও ঘোর চিন্তায় পড়ে যান, সমস্যা মেটাতে শেষমেষ মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেন। ঘরে-বাইরে এমন নানাবিধ প্রতিকূলতা ও প্রশ্নের মুখোমুখি তে হতে মেয়েরও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। গত মে মাসে আচমকা বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান কলেজ পড়ুয়া তরুণীটি। থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেও মেয়েকে না পেয়ে মা বাধ্য হয়ে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন।
মেয়েকে খুঁজে দেওয়ার জন্য বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী ও বিচারপতি রাজা বসুচৌধুরীর ডিভিশন বেঞ্চে আরজি জানান। আদালতের নির্দেশে পুলিশ তদন্তেও নামে। একটি হোমে তাঁর সন্ধান মেলে। পুলিশ সেখানে গেলে তিনি লিখিতভাবে জানিয়ে দেন, কেউ তাঁকে জোর করে নিয়ে যায়নি, তিনি স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়েছেন। পরিবার ও পড়শিদের নানাবিধ বিরূপ মন্তব্যে তিনি টিকতে পারছিলেন না বলে পুলিশকে জানান ওই তরুণী।
পরে আদালতের নির্দেশে পুলিশের সঙ্গে মা হোমে যান মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে, যদি বুঝিয়ে-সুজিয়ে ফেরানো যায়। লাভ হয়নি। বরং শুক্রবার মামলাটির শুনানিতে হাজির হয়ে তরুণী আদালতের সামনেই পরিবারের বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ উগরে দেন, মাকেও রেয়াত করেননি। মেয়েটির অভিযোগ, তিনি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর অমতে বাড়ির লোক বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। তাই তিনি গত ২০ মে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কসবায় এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হোমে গিয়ে ওঠেন। এদিন ভরা এজলাসে মা-কে দেখেই তিনি ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, “কেন এসেছ এখানে? আমি যাব না তোমাদের সঙ্গে।”
এমতাবস্থায় আদালতও মামলার যাবতীয় নথি ও পুলিশের রিপোর্টের ভিত্তিতে পরিবারের দায়ের করা হেবিয়াস করপাস মামলাটি খারিজ করে দেয়। যদিও তবে তরুণীর এ হেন আচরণ যে একান্তই অবাঞ্ছিত, বিচারপতিরা তা-ও স্পষ্ট করেছেন। আদালতের বক্তব্য , কোনও সাবালিকা অবশ্যই স্বেচ্ছায় বাড়ি ছাড়তে পারেন, কিন্তু তা বলে মাকে দুর্ব্যবহার করে ফিরিয়ে দিতে পারেন না। যে মা তাঁকে দশ মাস দশদিন গর্ভে ধারণ করে বড় করে তুলেছেন, সেই মায়ের প্রতি সন্তানের দুর্ব্যবহার কখনওই প্রত্যাশিত নয়।
ডিভিশন বেঞ্চের আরও মত, “বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানানসই নয়, কারও মধ্যে তেমন কিছু পরিবর্তন দেখলে সামজের উচিত সেটাকে মানিয়ে নেওয়া। একই ভাবে সেই ব্যক্তিও আপন তাঁর পরিবারকে দূরে ঠেলে দিয়ে দুঃখ দিতে পারেন না, আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে তা বেমানান।” পরিশেষে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের আইনজীবীদের প্রতি আদালতের পরামর্শ, “মেয়েটিকে বোঝানোর চেষ্টা করুন, প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করুন।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.