রাহুল রায়: ঠিক যেন পর্দার ‘পোস্ত’-র অ্যাকশন প্লে। রিয়েল লাইফে। বছর পাঁচেক আগে মুক্তি পেয়েছিল বাংলা সিনেমা ‘পোস্ত’। সাত বছরের শিশুর উপর অধিকার নিয়ে একই পরিবারের দুই প্রজন্মের বিরোধের গল্প। জন্মের পর থেকে মানুষ করা প্রাণাধিক প্রিয় নাতিকে নিজের কাছে আঁকড়ে ধরে রাখতে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন দাদু। আবার চিত্রনাট্যের ক্ল্যাইম্যাক্সে চূড়ান্ত রায়দানের ঠিক আগেই জিততে চলা মামলা তুলেও নেন নাতিকে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে।
এবার সেই কাহিনিই বাস্তবে। সাত বছরের শিশুকন্যাকে ফিরে পেতে নিজের বাবা-মার বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ মেয়ে। কলকাতা হাই কোর্টে (Calcutta High Court) সাড়া ফেলা সেই মামলায় দু’পক্ষের সাওয়াল জবাব শেষে বিচারপতির সিদ্ধান্ত, জন্মদাত্রী মায়ের কাছ থেকে তাঁর কোলের সন্তানকে আলাদা করা যায় না। মায়ের আদর থেকেও সন্তানকে বঞ্চিত করা যায় না।
সন্তানের উপর অধিকার নিয়ে মামলা নতুন কিছু নয়। তবে এতদিন টানাপোড়েন মূলত দেখা গিয়েছে সন্তানের বাবা ও মায়ের মধ্যে। কখনও বা গর্ভজাত সন্তানের অধিকার চেয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন পুত্রবধূ। জটিল পারিবারিক বিরোধের মীমাংসায় আইনের শুকনো ধারার বদলে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নিতেও দেখা গিয়েছে বিচারপতিকে।
হাই কোর্টে সম্প্রতি যে মামলা নিয়ে চর্চা, সে ক্ষেত্রে অভিযোগ বেশ গুরুতর! নতুনতরও বটে! কারণ এক্ষেত্রে তাঁর সাত বছরের কন্যাসন্তানকে আটকে রাখার অভিযোগে নিজের বাবা-মা’র বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছেন মেয়ে। অভিযোগকারিণী শতাব্দী কুণ্ডুর বক্তব্য, নাতনিকে দাদু-দিদাই মায়ের কাছে আসতে দিচ্ছে না। অভিযোগকে কার্যত ‘নজিরবিহীন’ বলেই মত আইনজীবীদের একাংশের।
আদালতের কাছে মামলাকারীর আইনজীবী সঙ্গীতা রায় ও দেবপ্রিয়া মিত্র জানান, “গত বছর এপ্রিল মাসে স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয় তাঁদের মক্কেল শতাব্দী কুণ্ডুর। সে সময় শিশুকন্যার ভার গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন তার বাবা। সদ্য বিবাহ বিচ্ছেদের পর আর্থিক সমস্যার কারণে শতাব্দীদেবী শিশুকন্যাকে নিয়ে তাঁর বাবা-মায়ের বাড়িতে ওঠেন। পরবর্তীকালে বেসরকারি সংস্থায় চাকরি পেয়ে যাওয়ায় আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন। এই সময় এক যুবকের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় শতাব্দীদেবীর। দু’জনে বিয়েও করেন। দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে সংসার শুরুর পর তাঁর বাবা মায়ের কাছ থেকে কন্যাসন্তানকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে চান শতাব্দীদেবী।
গোল বাধে তখনই! শতাব্দীদেবীর বাবা-মা তাঁদের নাতনিকে হাতছাড়া করতে রাজি হননি। তাঁরা জামাইয়ের কাছে নাতনিকে তুলে দিতে রাজি। কিন্তু মেয়ের কাছে নাতনিকে তুলে দিতে চান না। যা শুনে গর্ভজাত মেয়েকে কাছে পেতে চেয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হন মা। কিন্তু পুলিশ কোনও পদক্ষেপ না নেওয়ায় হাই কোর্টে সন্তানের খোঁজ চেয়ে ‘হেভিয়াস কর্পাস’-এর মামলা করেন তিনি।
হাই কোর্টে মামলার শুনানিতে শতাব্দীদেবীর আইনজীবীদের দাবি, পুলিশ নাবালিকা কন্যাসন্তানকে উদ্ধার করে মা অর্থাৎ তাঁদের মক্কেলের কাছে পৌঁছে দিক। রাজ্যের কৌঁসুলি আনসার মণ্ডল জানান, এটা একান্তই পারিবারিক ব্যাপার। যেখানে নিজের সন্তানকে কাছে পেতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন তাঁর বাবা-মা-ই, সেখানে পুলিশ কী করবে! বিচারপতি শম্পা সরকার জানিয়েছেন, “নাবালক-নাবালিকার উপর তার বাবা, ঠাকুমা-ঠাকুরদা বা দাদু-দিদার যেমন অধিকার রয়েছে, ঠিক একইভাবে তুলনামূলক বেশি অধিকার রয়েছে জন্মদাত্রী মায়ের। তাঁকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। মাকে তাঁর কোলের সন্তানের কাছ থেকেও আলাদা করা যায় না।” বিচারপতি জানিয়ে দেন, সন্তান কার কাছে থাকবে, তার বিচার করবে সংশ্লিষ্ট নিম্ন আদালত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.