ছবি: প্রতীকী।
অভিরূপ দাস: সংগীতে তাঁর আমৃত্যু অনুরাগ। হাসপাতালের বেডেও তাল ঠুকে গাইতেন রবীন্দ্র সংগীত। সেই তিনি মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকবেন সংগীতের মধ্যে দিয়ে। তাঁর মৃত্যুর গাফিলতির খেসারত দিতে ফি-বছর দরিদ্র মেধাবী এক সংগীতের ছাত্রকে টাকা যোগাতে হবে হাসপাতালকে। রাজ্য স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রক কমিশনের ইতিহাসে এই রায় অভিনব এবং অদ্ভুত।
দীর্ঘদিন ধরেই মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন গলফগ্রিনের বাসিন্দা সুমন মজুমদার। চিকিৎসা পরিভাষায় এ অসুখের নাম স্কিৎজোফ্রেনিয়া। ২০১৯ এর শেষের দিকে আচমকাই অস্বাভাবিক ব্যবহার করতে শুরু করেন তিনি। জামাকাপড় খুলে ফেলতেন। চিৎকার করে উঠতেন আচমকা। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ভিনরাজ্যে থাকেন। কলকাতায় তাঁকে দেখভাল করতেন সায়কবরণ চক্রবর্তী। শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হলে সুমনবাবুকে যাদবপুর সেন্ট্রাল রোডের বাউলমন হাসপাতালে ভরতি করে দেন সায়ক। সায়কের কথায়, “ওনার সুগারের মাত্রা সাংঘাতিক বেড়ে গিয়েছিল। নিয়মিত ইনসুলিন দিতে হত। চিকিৎসকদের সে কথা আমরা বলে দিই।”
চিকিৎসা শুরু হয় সুমনবাবুর। মাঝেমধ্যে দেখতে যেতেন সায়কই। ফোনে খোঁজ নিতেন আত্মীয়রা। ২০২০ এর মার্চ থেকে শুরু হয় লকডাউন। করোনা আবহে পরিবারের লোকেদের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। একা থাকতে থাকতে মানসিক রোগ গ্রাস করে বছর তেষট্টির বৃদ্ধকে। নার্সরা জানিয়েছেন, ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার করতেন তিনি। ২০২০ সালের ১ মে মারা যান প্রৌঢ়। তারপরেই বাঁধে গন্ডগোল। সায়ক জানিয়েছেন, উনি মারা যাওয়ার আগের দিন ওনার সুগার টেস্ট হয়েছিল। তাঁর রিপোর্ট দেখেই চমকে যাই। সুগার ১৪০০! রক্তে চিনির মাত্রাকে (সুগার লেভেল) স্বাভাবিক করতে যে হরমোন অব্যর্থ সেটাই ইনসুলিন। দেহের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা রক্তের বিটা কোষগুলোকে নষ্ট করে দিলেই ইনসুলিন হরমোনের সৃষ্টি হয়। রক্তের বিটা কোষ যত বেশি করে নষ্ট হয়, তত বেশি পরিমাণে শরীরে ইনসুলিন তৈরি হতে পারে। সুমনবাবুর অগ্ন্যাশয় এই ইনসুলিন তৈরি করতে পারত না। তাঁকে নিয়মিত ইনসুলিন ইঞ্জেকশন দিতে হত। বাউলমন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে লকডাউনে এই ইনসুলিন ইঞ্জেকশনই পাওয়া যায়নি।
ভয়ের বিষয় অন্য জায়গায়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এন্ডেক্রিনোলজিস্ট ডা. অনির্বাণ সিনহা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন কোনও সুগারের রোগীকে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন না দেওয়া হলে তাঁর মস্তিষ্কের কিছু কোষ ফুলে যায়। যার ফলে রোগী প্রথম কোমায় চলে যান। এরকম যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর জন্য হাসপাতালকেই দায়ী করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রক কমিশন। কার্যত বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে এমন রায় দিয়ে কড়া ব্যবস্থা নিয়েছে কমিশন।
স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রক কমিশনের চেয়ারম্যান অসীমকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ ঘটনা জরিপ করে সাড়ে দশ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে বাউলমন হাসপাতালকে। এর মধ্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবেন সায়ক। সুমনবাবুকে যিনি দেখাশোনা করতেন। বাকি ১০ লক্ষ টাকা তুলে দিতে হবে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের হাতে। ঠিক হয়েছে ওই টাকা ব্যাঙ্কে থাকবে। ফি বছর ওই টাকায় দরিদ্র মেধাবী এক সঙ্গীতের ছাত্রকে স্কলারশিপ দেওয়া হবে। গান শেখানোর ইচ্ছে ছিল রবীন্দ্রনুরাগী সুমনের। মৃত্যুতে পরোক্ষে সে কাজেই যুক্ত হলেন তিনি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.