সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়: অপরাধ তাঁর একটাই! সময় পেলেই ঘুরে বেড়ান পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ায় শবরদের গ্রামে গ্রামে। অভাব-অভিযোগ মেটানোর চেষ্টা করেন। সঙ্গে নিজের বেতনের টাকায় একটা স্কুলও চালান শবর শিশুদের জন্য।
এহেন গুরুতর (!) অপরাধের কারণে কঠিন শাস্তির মুখে পড়তে চলেছেন অরূপ মুখোপাধ্যায়। চাকরি হারাতে বসেছেন কলকাতা পুলিশের দক্ষিণ ট্রাফিক গার্ডের এই কনস্টেবল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, কাজ বা ‘ডিউটি’-তে ফাঁকি দিয়ে শবরদের গ্রামে গিয়ে সেবামূলক কাজ করে চলেছেন তিনি। এই অভিযোগের ভিত্তিতে অরূপবাবুর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশও দিয়েছেন লালবাজারের ট্রাফিক কর্তারা। সেই তদন্ত প্রক্রিয়া শুরুও হয়ে গিয়েছে। দু’দফায় জেরার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ওই কনস্টেবলকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, “হয় মন দিয়ে ডিউটি করো। নয়তো চাকরি ছাড়ো।”
নিজের গাঁটের পয়সায় শবর সম্প্রদায়ের হতদরিদ্র মানুষদের জন্য কাজ করার ক’দিন আগে খবরের শিরোনাম আসেন অরূপ মুখোপাধ্যায়। পুলিশ কনস্টেবলের চাকরির সামান্য বেতনের টাকায় তাঁর এই অসামান্য উদ্যোগের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন সবাই। আদতে পুরুলিয়ার ছেলে অরূপ শবরজাতির জন্য কাজ করার প্রেরণা পেয়েছেন তাঁর দাদু বলরাম মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। ১৯৯৯ সালে তিনি কলকাতা পুলিশের চাকরি পান। তখন থেকেই পুরুলিয়ায় শবরদের জন্য একটি স্কুল খোলার স্বপ্ন দেখা শুরু। বেতনের টাকা জমিয়ে ২০১১ সালে পুঞ্চায় নবদিশা মডেল স্কুল নামে ওই স্কুলটি খোলেন তিনি। স্কুলের জন্য ১৪ কাঠা জমি দান করেন বন্ধুর বাবা ক্ষীরোদশশী মুখোপাধ্যায়। এরপর মা রেবা মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ৫০ হাজার ও ব্যাংক থেকে নেওয়া দেড়লক্ষ টাকা ঋণের সঙ্গে নিজের জমানো আড়াই লক্ষ টাকা দিয়ে নবদিশা মডেল স্কুল চালু করেন অরূপ। শুরুতে এই আবাসিক স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী ছিল ১৫ জন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৬ জন। শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে শবরদের অপরাধজগৎ থেকে সরিয়ে আনার লক্ষ্যে নিজের বেতনের টাকায় স্কুল চালিয়ে আসছেন টানা আট বছর। শবর গ্রামে অরূপ আজ ‘পুলিশবাবা’ এবং ‘শবরপিতা’ নামে পরিচিত। স্কুল চালাতে গিয়ে অরূপের বেতন এখন অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। সেইসঙ্গে ডিউটি ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে চাকরির একাধিক সুযোগ-সুবিধাও বাদ পড়েছে। এবার যেতে বসেছে চাকরিটাই।
অরূপ অবশ্য অকুতোভয়! বলছেন, “শবররা আমার প্রাণ। তাঁদের জন্য আমি সব কিছু করতে রাজি। দরকার পড়লে আমি চাকরি ছেড়ে দিতেও রাজি।” অন্যদিকে কলকাতা পুলিশের ডিসি (ট্রাফিক) সন্তোষ পাণ্ডে জানিয়েছেন, “কোনও পুলিশ কর্মী ডিউটির ফাঁকে অন্য কোনও কাজ করতেই পারেন। কিন্তু ডিউটি ফাঁকি দিয়ে নয়।” এবিষয়ে কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা জানান, “কনস্টেবল অরূপের এই কাজের বিষয় আমি জানি। তবে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে বলে জানতাম না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি।” অরূপের অবশ্য পুলিশের উপরতলার উপর কোনও ক্ষোভ নেই। তিনি জানান, “লালবাজারের উপরতলার কর্তারা আমার এই কাজের অনেকেই সমর্থন করেন। নিচুতলার কিছু পুলিশকর্মী এখন আমার চাকরি কেড়ে নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.