স্টাফ রিপোর্টার: অপরাধের মূলে রয়েছে কুসংস্কার। তাকে শিকড়সমেত উপড়ে ফেলা না গেলে দূর হবে না অপরাধ প্রবণতা। বরং তা উত্তরোত্তর বাড়বে।
ডাইনি হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাত অপরাধীর সাজা মকুব করে সম্প্রতি এমনটাই জানাল কলকাতা হাই কোর্ট। একই পরিবারের তিন মহিলাকে ‘ডাইনি’ তকমা দিয়ে তাঁদের খুন করার দায়ে ওই সাতজনের ফাঁসির হুকুম দিয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমা আদালত। কলকাতা হাই কোর্ট অবশ্য মনে করেছে, ‘মৃত্যুদণ্ড’ তো ছার। তার চেয়েও গুরুতর কোনও সাজা এই মানসিকতা বদলাতে পারবে না। সমস্যা যখন গভীরে, তখন মূলশুদ্ধ তাকে দূর করা না গেলে অপরাধ প্রবণতা রোখা কঠিন বলে আদালত মনে করেছে।
কীসের প্রেক্ষিতে হাই কোর্টের এহেন পর্যবেক্ষণ?
পশ্চিম মেদিনীপুরের দুবরাজপুর এলাকার হরিদাসপুরের ঘটনা।
[ শহিদ মিনারে বসার অনুমতি দিচ্ছে না সেনা, শহরের চার পয়েন্টে এবার বাজি বাজার ]
২০১২-র শুরু থেকেই একের পর এক বিপদ ঘটছিল মুণ্ডা উপজাতি অধ্যুষিত গ্রামটিতে। শেষপর্যন্ত বিপদের ‘কারণ’ খুঁজে বার করে গ্রামের মোড়লরা। একই পরিবারের তিন মহিলা সম্বরী সিং, ফুলমণি সিং ও সোমবারি সিংকে ডাইনি সাব্যস্ত করা হয়। গ্রামের মাথা থোবা সিংয়ের নেতৃত্বে সালিশি সভায় যাবতীয় অনর্থের জন্য তিন মহিলার ‘ডাইনিবৃত্তি’কে দায়ী করা হয়। দেওয়ার ক্ষমতা নেই জেনেও তাঁদের ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করে থোবা সিং ও তার দলবল। এরপরই তিন অসহায় মহিলার উপর নেমে আসে অকথ্য অত্যাচার। লাথি, কিল, ঘুসি মারতে মারতে সেখানেই তাঁদের আধমরা করা হয়। তিনজনের মুখে প্রস্রাব করে দেওয়া হয়। শেষমেশ তাঁদের টেনে হিঁচড়ে কংসাবতীর চরে নিয়ে যায় থোবা সিং, গণেশ সিং, সানি মান্ডি, বাবলু সিংরা। গোটা ঘটনার সাক্ষী ছিলেন সোমবারি সিংয়ের স্বামী লক্ষ্মীকান্ত সিং। সালিশি সভায় তাঁকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। ঘটনার পরদিন নদীর চর থেকে ওই তিন মহিলার ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার করা হয়।
লক্ষ্মীকান্তর অভিযোগের ভিত্তিতে দাসপুর থানার পুলিশ তদন্তে নামে। পরে ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্ত হয়। ষড়যন্ত্র ও হত্যা-সহ একাধিক ধারায় মোট ৪৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা পড়ে। এরমধে্য ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মূল অভিযুক্ত থোবা সিং সহ পলাতক ২৪ জন। বেশ কয়েক মাস বিচারপর্ব চলার পর ঘাটাল আদালতের অতিরিক্ত দায়রা বিচারক অভিযুক্ত সানি মাণ্ডি, ভাকু সিং, রবীন সিং, মঙ্গল সিং, নূরা সিং, সামাই মান্ডি, কালী সিংকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। এছাড়াও ঘটনায় অভিযুক্ত ছয় মহিলাকে যাবজ্জীবন কারাবাসের নির্দেশ দেন দায়রা বিচারক।
[ তোলা দিতে রাজি না হওয়ায় দমদমে প্রোমোটারকে লক্ষ্য করে গুলি ]
নিম্ন আদালতের নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয় সাত মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত। বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী ও বিচারপতি শম্পা সরকারের ডিভিশন বেঞ্চ মামলার শুনানির পর তাদের সাজা মকুব করেছে। পাশাপাশি কুসংস্কারের এই প্রাণঘাতী দাপট দেখে তীব্র মর্মবেদনা ও উদ্বেগ প্রকাশ করে আদালতের মন্তব্য, ভাবতেও আবাক লাগে যে, “স্বাধীনতার ছয় দশক পরেও এমন ঘটনা ঘটছে। এটা ভাবতেই অবাক লাগে। সমাজ বিশেষত পিছিয়ে পড়া শ্রেণি যদি এখনও এমন কুসংস্কারে নিমজ্জিত থাকে, সেখানে রাজ্য সরকার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। বরং সরকারি শিক্ষানীতিতে অবিলম্বে বদল এনে সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির অজ্ঞতা দূর করাই সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব।” আদালতের নির্দেশ, তফসিলি জাতি ও উপজাতি অংশের মানুষের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে অবিলম্বে বিষয়টিকে শিক্ষানীতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নিবিড় প্রচার কার্যক্রম চালিয়ে সমাজ থেকে উপড়ে ফেলতে হবে কুসংস্কারের অন্ধকার।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.