রমেন দাস: এত টাকা! রাত থেকে সকাল, শুধুমাত্র দু’হাজারের নোট বদলের জন্য হন্য়ে হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বহু মানুষ। সংসার সামলে মলিন পোশাক আর আধখাওয়া পেটেই লাইনে ভিড় উৎসুক জনতার! আপাতদৃষ্টিতে দেখলে সেটাই স্বাভাবিক। নিজের কাছে থাকা ২ হাজারের নোট বদলের জন্য এখন একমাত্র উপায় রিজার্ভ ব্যাংক (RBI – Reserve Bank of India) ! কিন্তু এখানেই উঠেছে প্রশ্ন! আচমকা এত ২ হাজারের (2000 Notes) নোট বদলের হিড়িক কেন? কেন তথাকথিত নুন আনতে পান্তা ফুরানো মানুষেরই ভিড় কলকাতার (Kolkata) রিজার্ভ ব্যাংকের সামনে! কোথায় ছিল এত টাকা! সত্যিই কি সব টাকা ওঁদের?
একাধিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল পৌঁছে গিয়েছিল ডালহৌসি চত্বরের আরবিআই দপ্তরের সামনে। কী উঠে এল সেখানে?
দেখুন ভিডিও:
মহাসমারোহে লাইন সামলাচ্ছেন নিরাপত্তারক্ষীরা। ব্যারিকেডের ভিতর-বাইরে গিজগিজ করছে ভিড়। এর মধ্যে বেশিরভাগই মহিলা অথবা বৃদ্ধ। প্রত্যেকেই এসেছেন ২ হাজারের নোটবদলের জন্য। কারও হাতে ব্যাগ, কেউ আঁচলে বেঁধে রেখেছেন গোলাপি বর্ণের নোট। এঁদের প্রায় সকলের কাছেই রয়েছে ৫টি করে ২ হাজার টাকার (2000 Currency) নোট। আবার সপরিবার এসেছেন কেউ কেউ। সকলে মিলেই বদলে নেবেন নাকি টাকা! এখানেই গাঢ় হয়েছে সন্দেহ। এত টাকা এল কীভাবে, নাকি হাজার হাজার মানুষের এই ভিড়ের কাছেই ছিল এই পরিমাণ টাকা।
এখানেই রয়েছে জট! এই লাইনের একটু কাছে যেতেই উঠে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য। লাইনে দাঁড়ানো অধিকাংশই সংবাদমাধ্যম দেখে মুখ লুকোতে ব্যস্ত। তবুও মুখ লুকোতে ব্যস্তদের মধ্যেই কেউ কেউ বলছেন, ”আমাদের ছবি তুলে কী করবেন, গরিব মানুষ কাজ নেই, এখানে এসে যদি দুটো টাকা হয়!”
মানে? রিজার্ভ ব্যাংকে টাকা বদলাতে এসে রোজগার! একটু এগোতেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হল আরও। দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে আসা এক মহিলা বললেন, ”লোকের বাড়িতে কাজ করি, আজ যাইনি। এখানে আসার পরে একজন আমাকে ৫টা নোট দিয়েছে। কার টাকা জানি না। কাজ করে দেব, টাকা নেব, চলে যাব। আবার বললে লাইনে দাঁড়াব!”
প্রায় একই সুরে দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে আসা এক যুবকের অভিযোগ, ”তিনদিন ধরে ঘুরছি, নিজের টাকা বদল করতে পারছি না। এখানে সব কালোবাজারি চলছে। অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কিন্তু জানেনই না কার টাকা নিয়ে বদল করছেন।” আবার কেউ এসেছেন বারাকপুর থেকে ‘মালিকের টাকা’ বদল করতে। এক যুবক বলছেন, ”আমাদের টাকা নেই, আমরা তিনজন এসেছি মালিকের টাকা বদল করতে।”
অর্থাৎ টাকা রয়েছে। বদল চলছে। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে রিজার্ভ ব্যাংকের নিয়ম মেনেই লাইনে-লাইনেই চলছে কালোবাজারিও! আর এখানেই উঠছে প্রশ্ন, আদৌ কোটি কোটি ২ হাজারের নোটের মালিক কে, জানেন না লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকেই।
বিষয়টি আর একটু খতিয়ে দেখতে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসুক যুবকদের দিকে যেতেই জোরে দৌড় লাগালেন ওঁরা। ওঁদের প্রত্যেকের হাতেই পেন এবং ডায়েরি। যদিও কাউকে পাওয়া গেল, সকলেই বললেন, ‘এমনি দাঁড়িয়ে’ আছেন। আবার কেউ কেউ জানালেন, ‘লাইন ঠিক করছেন’। কিন্তু এখানেই বিস্ফোরক অভিযোগ করলেন পূর্ব মেদিনীপুর থেকে আসা এক যুবক। তাঁর দাবি, ”লাইনের আশপাশে ছোট ছোট ব্যাগ নিয়ে ঘুরছেন লোকজন। এঁরা লোক ভাড়া খাটিয়ে টাকা বদলের কারবার করছেন। খুঁজলেই পাবেন।”
সত্যিই কি তাই? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তির দাবি, ”কার টাকা, কীসের টাকা বলব না। কিন্তু একজন বারবার লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা বদলে আনছেন এটা সত্যি। আর সেই বদলের জন্য পারিশ্রমিকও দিচ্ছি আমরা।” কেমন পারিশ্রমিক? ওই যুবকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আর এক যুবকের দাবি, ”৫টা নোট বদলে দিলে ৩০০ টাকা। অর্থাৎ ১০০০০ টাকার কাজে ৩০০ টাকা রোজগার।”
ঠিক একই দাবি করছেন বিভিন্ন জেলা থেকে আসা অনেকেই। হুগলি থেকে আসা এক মহিলার দাবি, ”আয়ার কাজ করি। কাজে যাইনি। এখানে রোজ আসছি। যদি কিছু হয়।” আবার ওই লাইনেই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা তিন মহিলা মুখ লুকিয়েই বললেন, ”বাড়িতে কেউ জানে না এখানে এসেছি, ছবি দেখলে অশান্তি হবে। ছাড়ুন না আমাদের!”
এখানেই উঠেছে প্রশ্ন। একজন ৫টি ২ হাজার টাকার নোট বদল করছেন অন্যের জন্য? শুধু তাই-ই নয়, একাধিক বার নোট বদলের জন্য লাইনে দাঁড়াচ্ছেন অন্য়ের কাজ করে দেবেন বলে! কিন্তু কী করছে পুলিশ? ভিড় নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা এক মহিলা পুলিশ আধিকারিকের দাবি, ”কী করব আমরা, অনেক কিছুই তো চলেছে, সব কি ঠিক নাকি!”
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর ৫০০ এবং ১ হাজার টাকার নোট বাতিল করেছিল নরেন্দ্র মোদির (Narendra Modi) সরকার। এই বাতিল (Notebandi) ঘিরে তোলপাড় হয়েছিল গোটা দেশ। ৭ বছর পর ফের ২ হাজার টাকার নোট বাজার থেকে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও বিতর্ক হয় বিস্তর। ধাপে ধাপে বাড়ে নোট বদলের তারিখও। কিন্তু সম্প্রতি দেশজুড়ে রিজার্ভ ব্যাংকের ১৯ দপ্তরেই মিলছে ২ হাজারি নোট বদলের সুবিধা। কলকাতাতেও চলছে এই কাজ। বাতিল না হলেও এই নোট বাজার থেকে তুলে নিচ্ছে রিজার্ভ ব্যাংক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.