সোম রায়, শ্রীনগর: ক্রিকেট খেলতে পারা কি ‘আজাদি’ হতে পারে? হতে পারে স্বাধীনতা সমান? সে অর্থে কোনও রক্তপাত নেই। ফাঁকা রাস্তায় দূর থেকে যে দৌড়ে আসছে, তার হাতে বোমা নেই, রয়েছে বল। বিপক্ষের হাতেও একে-৪৭ নেই। রয়েছে একটি নিরপরাধ কাঠের ব্যাট। কতদিন পর তাদের এই হইচই? যুদ্ধ যেহেতু নেই, তাই এ এক ‘অপরাজিত’ আনন্দ। দু’পক্ষেরই। ক্রিকেট খেলার। ভোটের দিন। ফাঁকা রাস্তা। মিলিটারিদের ব্যারিটোন জুতোর কোনও পায়চারি নেই। নেই অন্য দিনের মতো সুতীব্র সন্দেহ-চাউনি। স্থান শ্রীনগর। দর্শক আমি। ইতিউতি ছড়ানো ছিটনো নিশ্চিন্ত লোকের অস্থায়ী জটলা।
[ আরও পড়ুন: নির্বাচনে শামিল মানসিক রোগীরাও, দেশে প্রথম হাসপাতালেই ভোটকেন্দ্র]
জো তুম না দোগে আজাদি। হাম ছিনকে লেঙ্গে আজাদি। বছর তিনেক আগে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই স্লোগান ছড়িয়ে পড়ছিল আসমুদ্রহিমাচল। সেদিন জেএনইউ-এর বাম ছাত্র আন্দোলনের নেতা কানহাইয়া কুমারের গায়ে ‘দেশদ্রোহী’-র স্ট্যাম্প মারতে ছাড়েননি ‘দেশভক্ত’-রা। কিন্তু দমিয়ে রাখা যায়নি কানহাইয়া বা তাঁর স্লোগানকে। সম্প্রতি রণবীর সিংয়ের ‘গালি বয়’ সিনেমাতেও আজাদি নিয়ে তৈরি হয়েছে গান। একেকজনের কাছে ‘আজাদি’-র মানে একেকরকম। কারও কাছে আজাদি নিজের ভাব, মত প্রকাশ করার স্বাধীনতা। কারও কাছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে আবার ‘আজাদি’ মানে ভারত থেকে স্বাধীনতা। বিষয়টি বিতর্কিত, দীর্ঘ পরিসরে আলোচ্য। এই নিয়ে আলোচনার জন্য বহু তাবড় মানুষ রয়েছেন। তবে শেষ দেড় মাসে দু’দফায় কাশ্মীর এসে দেখলাম নিজেদের মতো করে ‘আজাদি’ খুঁজে নিয়েছে কাশ্মীরের তরুণ প্রজন্ম। এবং সেটা ‘যুদ্ধং দেহি’ মুডে নয়। প্রথম দফার কাশ্মীর সফরে এসে দু’দিন কার্ফু পেয়েছিলাম। সেই সময় ডাল গেট, লাল চকের রাজপথে ক্রিকেট খেলতে দেখেছি স্থানীয়দের। এবারও শ্রীনগর পৌঁছে প্রথম দিন মনে হল রিপিট টেলিকাস্ট দেখছি। সেদিন বারামুল্লা কেন্দ্রে ভোট ছিল। তবু হুরিয়তি হুমকিতে ঘুমিয়ে ছিল শ্রীনগর। ব্যস, আর যায় কোথায়? ‘আজাদি’-র লড়াইয়ে পথে নেমে পড়ে কাশ্মীরি যুবরা।
[ আরও পড়ুন: লিভারের ৬৫ শতাংশ বাবাকে দান, তরুণীর সাহসকে কুর্নিশ নেটদুনিয়ার ]
স্রেফ ক্রিকেট খেলতে। কোথাও ইট পেতে, কোথাও কোল্ড ড্রিংক্সের পেটি দাঁড় করিয়ে, পাথর সাজিয়ে, কোথাও আবার টিন লাগিয়ে খাড়া করা হয়েছে উইকেট। ঠিক যেভাবে আমরা ছোটবেলায় বনধের দিন রাস্তায় নেমে পড়তাম। সেই হুবহু ছবি, তসবির, এখানেও। শহর-এ-শ্রীনগর (শ্রীনগর শহর)-এর রাজপথ দখল করেছে ‘আজাদি’ সৈনিকরা। শহর-এ-খাস (ডাউনটাউন বা ওল্ড শ্রীনগর)-এ অবশ্য তারা ভিড় করছে মাঠে। কোথাও উইকেটের পিছনে ছবির মতো পাহাড়। কোথাও আবার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ঝরনা। এর মধ্যেই ক্রিকেট খেলতে খেলতে চুটিয়ে মস্তি করছে কিশোর, তরুণ, যুবরা। কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির মাঠে কয়েকজনকে খেলতে দেখে, একটু কথা বলতে গেলাম। শুনলাম প্রতি রবিবার ওখানে ‘আজাদি’-র মহাসম্মেলন হয়। মানে ক্রিকেটের মেলা বসে। ঠিক যেমন আমাদের গড়ের মাঠে। যারা খেলছিল, তাদের মধ্যে এক হোমরাচোমরা এগিয়ে এসে বলল, ‘দেখো ভাই ইলেকশন সে হামে কেয়া?’ বাকিটুকুর বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়, ‘আমাদের বেশিরভাগেরই নাম ওঠেনি। উঠলেও ভোট দিয়ে কী হবে? এর থেকে এই দিনগুলোয় সেনারা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে। গাড়িও চলে না। আমরা চুটিয়ে ক্রিকেট খেলি।’
[ আরও পড়ুন: জেট জট অব্যাহত, ৪৪০টি শূন্যপদ নিচ্ছে অন্য বিমান সংস্থা ]
এতদিন অভিজ্ঞ, বয়স্ক অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তবে ভূস্বর্গের যুব সম্প্রদায়ের সঙ্গে কথা বলে মনটা হালকা হয়ে গেল। বুটের শব্দ, গুলির শব্দ ওদের ছোটবেলা জুড়ে। মিলিট্যান্সি অত্যাচার সয়ে এসেছে বরাবর। ওরা বিরক্ত, এই একইরকম স্তব্ধ, চাপা হিংস্র জীবন দেখতে দেখতে। শাঁখের করাতের মতো কাটা পড়ছে দু’দিক থেকে-সরকার ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মাঝে পড়ে গিয়ে। ওরা ‘আজাদি’ চায়। এই গুমট পরিবেশ থেকে। বিচ্ছিন্নতাবাদ থেকে। ব্যাট ছুঁয়ে বল যে মাটিতে এসে পড়ে, তাতে যেন কোনও রক্তের ছাপ না থাকে-‘আজাদি’ বলতে সম্ভবত এটাই বোঝাতে চেয়েছে কাশ্মীরের ওইসব যুবক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.