Advertisement
Advertisement

Breaking News

Dawood Ibrahim

আজও অধরা দাউদ, কীভাবে ‘ডন’ হয়ে উঠেছিল মুম্বই পুলিশের এক সৎ কনস্টেবলের ছেলে?

কেন ভারতে ফেরানো যায়নি অন্ধকার জগতের বাদশাকে?

Why India Could not be able to bring Dawood Ibrahim। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:February 13, 2022 6:54 pm
  • Updated:February 13, 2022 7:12 pm  

বিশ্বদীপ দে: ”আমার মতো লোকের পাল্লায় পড়লে তোমার কী হবে? সে তো গায়ের জোরেই তোমাকে শুইয়ে দেবে।” এমন কথা শুনে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ছেলেটা। চকচক করে উঠেছিল তার চোখ, ”আমি আপনাকে চ্যালেঞ্জ করছি না ভাই। কিন্তু আমিও হালুয়া নই।” ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের এক নেহাতই রোগাপাতলা ছোকরার মুখে এমন প্রত্যুত্তর শুনে অবাক হননি খালিদ। খালিদ খান পাচা। জানতেন, ছেলেটার এই একরোখা ভাব স্রেফ কথার কথা নয়। এ সত্যিই সাঙ্ঘাতিক। নাহলে ডোংরির মতো ছোট এলাকা থেকে উঠে আসা একটা ছেলে, যার বাবা মুম্বই পুলিশের হেড কনস্টেবল, সে এমন নিপুণ দক্ষতায় রামপুরী চাকু চালাতে পারত না। সময়টা গত শতকের সাতের দশকের। দশাসই চেহারার পালোয়ান খালিদের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছে ছেলেটি।

সেদিন তাকে শেখাতে শেখাতে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি খালিদ, একদিন এই ছেলেটা হয়ে উঠবে বিশ্বত্রাস এক সমাজবিরোধী। তার অপরাধের পাল্লা ভারী হয়ে উঠবে এমন যে, দেশ ছেড়েই পালাতে হবে। অবশ্য তা বলে পলাতকের জীবন মোটেই কাটাচ্ছে না সে। একথা মোটামুটি সকলেরই জানা, প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান তাকে রাজার হালে রেখে দিয়েছে। দেখতে দেখতে ৬৬ বছর বয়স হয়ে গিয়েছে। আজও অধরা ডি কোম্পানির বেতাজ বাদশা দাউদ ইব্রাহিম (Dawood Ibrahim)। কেন তাকে দেশে ফেরানো গেল না? আদৌ কি কোনওদিনও ফেরানো যাবে? প্রশ্নগুলো সহজ নয়। উত্তরও অজানাই। কেবল তা হাতড়িয়ে দেখা যেতে পারে।

Advertisement
Dawood-young
‘মেন্টর’ খালেদ খানের সঙ্গে অল্পবয়সি দাউদ

[আরও পড়ুন: হিজাব বিতর্কের মাঝেই কর্ণাটকের স্কুলের ক্লাসরুমে নমাজ পড়ুয়াদের! ভাইরাল ভিডিও]

তবে তার আগে একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া দরকার। একবার ছুঁয়ে আসা প্রয়োজন ইব্রাহিম কাসকারের ছেলের মুম্বইয়ের অপরাধী চুড়োমণি হয়ে ওঠার ধাপগুলিকে। মুম্বই আন্ডারওয়ার্ল্ডের সূচনা সেই ছয়ের দশকে। বাণিজ্যনগরীর বুকে গজিয়ে উঠতে থাকা স্মাগলিং ও অন্য়ান্য অপরাধমূলক কাণ্ডকারখানা ততদিনে বেশ সাংগঠনিক চেহারা নিতে শুরু করেছে। নানা ছোট-বড় দল ছিল। দিশি পিস্তল, ছুরি, লাঠি, বোমা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় গ্যাংগুলির মধ্যে মারামারি লেগেই থাকত। সেই সময়ের একনম্বর ডন ছিল ভরত রাজন নামের এক দক্ষিণ ভারতীয়। মুম্বইয়ের বড় বড় ট্রেড ইউনিয়নগুলোতেও নাকি তার বিরাট প্রভাব ছিল। বলা হয়, সেই সময় আরবসাগরের পারের অপরাধ দুনিয়ায় দক্ষিণ ভারতীয়দেরই পাল্লা ভারী ছিল।

ঠিক সেই সময়ই অপরাধ দুনিয়ায় হাতেখড়ি হচ্ছে দাউদের। সপ্তম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা এগোয়নি। স্কুলে নিত্যদিন মারামারি করে বেড়াত সে। দাদা সাবির ইব্রাহিম কাসকরও তেমনই। তারা দু’জনে মিলে সংগঠিত ভাবে অপরাধমূলক কাজ শুরু করে দিয়েছিল। প্রথমে বাসু দাদা নামে এক স্থানীয় গুন্ডার হয়ে নানা রকম ছুটকো ছাটকা কাজ। সেখান থেকেই ক্রমে পাকাপোক্ত অপরাধী হয়ে ওঠা মুম্বই পুলিশের সৎ কনস্টেবলের দুই ছেলের! এ এক আশ্চর্য প্রহসন।

Dawood
আতঙ্কের অপর নাম দাউদ

[আরও পড়ুন: পাখির চোখ উত্তরাখণ্ডের বাঙালি ভোট, প্রচারে উদ্বাস্তু আবেগ উসকে দিলেন মোদি]

হুসেন জাইদি এদেশের এক অতি বিখ্যাত ক্রাইম রিপোর্টার। ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’র মতো বইয়ের লেখক তিনি। বছর ৫৩-র সেই সাংবাদিক দাউদ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। তিনি জানাচ্ছেন, এই সময়ই ‘মেন্টর’ খালিদ পালোয়ানের কাছে হাতেকলমে অপরাধী হওয়ার পাঠ নিয়েছিল দাউদ। এরপর সে গিয়ে জুড়ে যায় হাজি মস্তানের সঙ্গে। ততদিনে ভরত রাজনকে সরিয়ে দিয়ে হাজি মস্তান হয়ে উঠেছে এক নম্বর ডন। তবে তার গ্যাংয়ের সঙ্গে জোর টক্কর ছিল পাঠান গ্যাংয়ের। সেই দলও ছিল সাংঘাতিক। তাদের হাতেই খুন হতে হয় সাবিরকে। এর বদলা নিয়েছিল দাউদ। প্রায় একার পরিকল্পনাতেই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল পাঠান গ্যাংকে। এরপর হাজি মস্তান রাজনীতির দিকে চলে গেলে সমস্তা ক্ষমতার নিউক্লিয়াস হয়ে ওঠে একা দাউদ। মুম্বইয়ে শুরু হয় এক নয়া অন্ধকার যুগ।

যদিও তখন থেকেই দুবাইয়ে বসবাস শুরু করে দিয়েছে দাউদ। সেখান থেকেই চালাচ্ছে ডি কোম্পানি। ছোটা রাজনের মতো সঙ্গীসাথীদের নির্দেশ দিচ্ছে মরুদেশ থেকেই। বলা হয়, সেই সময় দাউদের ভয়ে কাঁপত গোটা মুম্বই। ভিতরে ভিতরে সমাজের প্রভাবশালীদের সঙ্গেও ছিল তার ওঠাবসা। এমনকী, পুলিশের ভিতরেও তার ‘সোর্স’ ছিল। ‘দাউদ ভাই’ ছিল আতঙ্কেরই অপর নাম।

এরপর আসে ১৯৯৩ সালের ১২ মার্চ। সেই ‘কালো শুক্রবারে’ দেশের প্রথম সন্ত্রাসবাদী হামলায় কেঁপে উঠেছিল মুম্বই। মোট ১৩টি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। যাতে মৃত্যু হয় ২৫৭ জনের। আহত হন ৭১৩ জন। কেবল মুম্বই-ই নয়, গোটা দেশই কার্যত থরথরিয়ে উঠেছিল মৃত্যু-রক্ত-ধ্বংসের নারকীয় রূপ দেখে। দাউদ ভয়ংকর, সেটা সবাই জানত। পূর্বসূরি হাজি মস্তানের মতো অনৈতিক কাজেও নির্দিষ্ট নীতি মেনে চলার কোনও বালাই ছিল না তার। হাজি কখনও নারী পাচারের মতো ঘৃণ্য ব্যবসায় হাত দেয়নি। দাউদ সেসবও করেছে চুটিয়ে। হাওয়ালা থেকে মাদক পাচার, কিছুতেই তার অরুচি ছিল না। কিন্তু এমন জঙ্গি হামলাও সে করে ফেলবে এটা সকলের কাছেই অকল্পনীয় ছিল। যদিও দাউদ প্রথমদিকে বলার চেষ্টা করেছিল, ওসব কাজ সে করেনি। টাইগার মেমনরা করেছে। কিন্তু সেই যে এসবের নেপথ্যে আসল কলকাঠি নেড়েছিল, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। ২০০৩ সালে ভারত ও মার্কিন সরকার দাউদকে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী’র তকমা দিয়েছে। তার নামের পাশে জুড়েছে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ শিরোপাও। শোনা যায় দাউদের ব্যবসা সারা বিশ্বে ছড়ানো। তার মোট সম্পত্তি ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের থেকেও বেশি। সেই অর্থেই সে দখলে রেখেছে বহু কিছু।

Mumbai Blast
মু্ম্বই বিস্ফোরণের কালো ছায়া আজও মিলিয়ে যায়নি

দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে প্রায় তিন দশক। মুম্বইয়ে আর নেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের দাপাদাপি। পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গিয়েছে। অলিতে গলিতে ছায়াবাজির মতো হানাহানি, কাটাকাটির সেই সময় বহু দূরে ফেলে এসেছে আজকের বাণিজ্যনগরী। কিন্তু এত কিছুর পরেও দাউদ রয়ে গিয়েছে বহাল তবিয়তেই। কী এমন কারণ রয়েছে যে তাকে দেশে ফেরানো যাচ্ছে না? গুঞ্জন রয়েছে, করাচি-সহ পাকিস্তানের কোথায় কোথায় দাউদের বাড়ি, সেসব জানা সত্ত্বেও এগোনো যায়নি। কিন্তু কেন?

এর পিছনে অন্যতম কারণ পাকিস্তানের (Pakistan) অসহযোগিতা। ইমরান খানের দেশ বরাবরই জোর গলায় বলেছে, দাউদ তাদের দেশে নেই। অথচ বারবারই প্রমাণ মিলেছে দাউদের সেখানে থাকার। আসলে পাকিস্তান যে তাকে আশ্রয় দিয়েছে, সেই ‘ঋণ’ ভালভাবেই চুকিয়েছে দাউদ। আক্ষরিক অর্থেই। জানা যায়, সেন্ট্রাল ব্যাংকের কাছে পাকিস্তানের বিপুল ঋণের একটা বড় অংশ সে শোধ করেছে। লস্কর-ই-তইবার মতো জঙ্গি দলকে দিয়েছে অস্ত্র কেনার টাকা। এখানেই শেষ নয়। নাইজেরিয়ার বোকো হারাম জঙ্গি গোষ্ঠীকেও বিস্তর অর্থ জুগিয়েছে দাউদ।

Dawood PaK house
মনে করা হয় করাচির এই বাংলোটি দাউদের

আরও একটা কারণের কথা শোনা যায়। মুম্বই বিস্ফোরণের আগে বহু দুঁদে রাজনীতিবিদ, যাঁদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে সাংসদও হয়েছেন, তাঁরা দাউদের থেকে প্রত্যক্ষ মদত নিয়েছিলেন। তালিকায় নাকি অন্যান্য ক্ষেত্রের প্রভাবশালীও রয়েছেন। বলা হয়, একবার দেশে ফিরলে দাউদ নাকি সকলের মুখোশ খুলে দেবে। আর সেই ভয়েই তাঁরা কেউ চান না দাউদকে দেশে ফেরাতে। তাই নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে চলেন নিরন্তর। এমন এক গুঞ্জন কিন্তু রয়েছে।

এবছরের আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস-বিরোধী সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি টি এস তিরুমূর্তি নাশকতামূলক ক্রিয়াকলাপ ও আন্তর্জাতিক অপরাধের মধ্যে যোগসূত্রের উল্লেখ করে জোরাল ভাবে এর মোকাবিলার পক্ষে সওয়াল করেছেন। এর মধ্যেই নতুন করে NIA-র তরফে UAPA তথা দেশদ্রোহিতার মামলা রুজু করা হয়েছে দাউদ ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে। তাহলে কি… ‘আশায় বাঁচে…’ এই প্রবাদকে ভরসা করা ছাড়া আপাতত উপায় নেই।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement