বিশ্বদীপ দে: ‘‘দিল্লি অউর দিল কি দূরি জলদ খতম করনা চাহতে হ্যায়।’’ একথা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর (PM Modi)। গত বৃহস্পতিবার জম্মু ও কাশ্মীর (Jammu & Kashmir) নিয়ে আলোচনার জন্য সর্বদল বৈঠক ডেকেছিলেন তিনি। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসের পর এই প্রথম কেন্দ্রের নেতাদের মুখোমুখি বিরোধীরা। মূলত গুপকার জোট (Gupkar alliance)। সেখানেই এমন কথা প্রধানমন্ত্রীর মুখে। যা শুনে নড়েচড়ে বসেছে ওয়াকিবহাল মহল। তবে কি বরফ গলছে? জম্মু ও কাশ্মীর কি সত্যিই আবার ফিরে পেতে পারে রাজ্যের মর্যাদা?
প্রশ্নগুলো সহজ নয়। উত্তরও জানা নেই কারও। আপাতত যা ঘটেছে, তা থেকে যে যার মতো করে আঁক কাটছেন খাতায়। সেই হিসেব মিলবে কিনা সময় বলবে। তবে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, মাঝের দমবন্ধ পরিস্থিতি হয়তো এবার কাটতে চলেছে। খুব বেশিদিন আগের কথা তো নয়। রাজনীতি সচেতন মানুষদের সকলেরই মনে স্পষ্ট হয়ে রয়েছে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু ও কাশ্মীর থেকে তুলে নেওয়া হয় বিশেষ মর্যাদা। সেই সঙ্গে রাজ্যকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করার প্রস্তাব পাশ হয় রাজ্যসভায়। পরদিন তা পাশ হয়ে যায় লোকসভাতেও। একটি জম্মু ও কাশ্মীর। অন্যটি লাদাখ। আর প্রায় সেই সময় থেকেই আলোচনাতে উঠে আসতে থাকে গুপকার জোটের কথা।
ঠিক কী এই গুপকার জোট? কেন জন্ম হয়েছিল এদের? এই সব প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক জম্মু ও কাশ্মীরের উপর থেকে বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের। না হলে কি কখনও কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিল কোনও দিন একছাতার তলায় আসবেন মেহবুবা মুফতি (Mehbooba Mufti) ও ফারুক আবদুল্লা (Farooq Abdullah)? ২০১৯ সালের ৪ আগস্ট প্রথম গুপকার ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ফারুক আবদুল্লা, ওমর আবদুল্লা, মেহবুবা মুফতি, মুজফফর হুসেন বেগের মতো রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় নেতারা একসঙ্গে শপথ নিয়েছিলেন জম্মু ও কাশ্মীরের অখণ্ডতা রক্ষা করতে লড়াই চালাবেন তাঁরা।
কিন্তু এর পরের দিন রাজ্যসভায় বিলটি পাশ হতে না হতেই বদলাতে থাকা পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়। গৃহবন্দি হন মুফতি, ফারুক আবদুল্লারা। এর প্রায় এক বছর পরে ২০২০ সালের ২২ আগস্ট স্বাক্ষরিত হয় দ্বিতীয় গুপকার ঘোষণাপত্র। জোট বাঁধে ৬টি দল। ‘জম্মু ও কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স’, ‘জম্মু ও কাশ্মীর পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’, ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট)’, ‘জম্মু ও কাশ্মীর আওয়ামি ন্যাশনাল কনফারেন্স’, ‘জম্মু ও কাশ্মীর পিপলস মুভমেন্ট’ এবং ‘জম্মু ও কাশ্মীর পিপলস কনফারেন্স’। তৈরি হয় ‘পিপলস অ্যালায়েন্স ফর গুপকার ডিক্লারেশন’। জম্মু ও কাশ্মীরের পুরনো পতাকাই তাদের পতাকা। শোনা যেতে থাকে তাদের সঙ্গে রয়েছে কংগ্রেসও। খোদ ফারুক আবদুল্লা দাবি করেন, কংগ্রেস তাঁদের সঙ্গেই আছে, থাকবেও। একসঙ্গে হাতে হাত ধরে স্থানীয় নির্বাচনে লড়াই করবে। যদিও তার কয়েক দিন পরেই সব জল্পনা উড়িয়ে দিয়ে কংগ্রেস জানিয়ে দেয়, তারা ওই জোটের সঙ্গে মোটেই নেই।
গুপকার জোটের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল উপত্যকায় জেলা উন্নয়ন পরিষদের নির্বাচন। যেটা ছিল ২০১৯ সালের আগস্টের পরে সেখানকার প্রথম নির্বাচন। আর সেখানেই বিজেপিকে সরিয়ে দিয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যমাত্র নেয় জোট।
উত্তেজনা বাড়তে থাকে রাজনৈতিক মহলে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ (Amit Shah) ‘গুপকার ঘোষণাপত্র’-এ স্বাক্ষরকারী দলগুলিকে ‘গুপকার গ্যাং’ বলে কটাক্ষ করেন। দেগে দেন ‘দেশবিরোধী’ হিসেবে। এমনকী তিনি এই অভিযোগও আনেন, গুপকার জোট চায় বিদেশি শক্তিও জম্মু ও কাশ্মীরের ইস্যুতে নাক গলাক। পালটা মুফতিও বলেন, বিজেপি নিজেই যেখানে সংবিধান লঙ্ঘন করে চলেছে, সেখানে এমন কথা তাদের মুখে নিতান্তই হাস্যকর।
সোজা কথায়, ভোটের দামামা বেজে ওঠে। কেবল কাশ্মীরের মানুষরাই নন। গোটা দেশের কৌতূহল তুঙ্গে ওঠে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ভোটগ্রহণের পরে গণনা শুরু হতেই দেখা যায় এক স্পষ্ট বিভাজন। যেখানে কাশ্মীর উপত্যকায় গুপকার জোটকেই ঢেলে ভোট দিয়েছেন ভোটাররা, সেখানে জম্মুতে বিজেপিরই প্রাধান্য। শেষ পর্যন্ত মোট ১১০টি আসন পায় গুপকার জোট। বিজেপি শেষ করে ৭৫-এ।
ভোটের ফলাফলে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে যায়। গুপকার জোটকে কাশ্মীরের মানুষ গ্রহণ করেছেন। মনে হচ্ছিল ১০টি জেলার মধ্যে অন্তত পক্ষে ৬টিতেই জেলা উন্নয়ন পর্ষদের সভাপতি, সহ-সভাপতি গুপকার জোট থেকে নির্বাচিত হবেন। বাকি আরও তিনটি জেলার ক্ষেত্রেও নিদর্লীয় বিজয়ীদের মধ্যে মাত্র একজন করে সমর্থন করে দিলে সেখানেও গুপকার জোটের সদস্যই ক্ষমতায় আসবেন। কিন্তু তা হয়নি। তার আগে জোটের মধ্যেই ঐক্যের অভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে! ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি জোট ছেড়ে বেরিয়ে যায় ‘জম্মু ও কাশ্মীর পিপলস কনফারেন্স’। জোটকেও সন্তুষ্ট থাকতে হয় অনন্তনাগ, কুলগাম, পুলওয়ামা, বান্দিপোরা ও গান্দেরবাল- এই পাঁচটি জেলা পরিষদ নিয়েই। যে নির্দল প্রার্থীরা জিতেছিলেন নির্বাচনে, তাঁরাও সেভাবে সমর্থন করেননি জোটকে।
এবং ‘জম্মু ও কাশ্মীর আপনি পার্টি’। এই আপনি পার্টিকে মনে করা হচ্ছে মোদি সরকারেরই তৈরি করা এক দল। কার্যত গুপকার জোটকেই টক্কর দেওয়ার জন্যই তাদের তৈরি করা হয়েছে। কেননা তারাও কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে সরব। যদিও ৩৭০ ধারা ফিরিয়ে আনার পক্ষপাতী নয় তারা। এই দলটি ২০টি জেলায় মাত্র ১২টি আসনে জিতেও দু’টি পর্ষদে নিজেদের দখলে নিতে পেরেছে স্রেফ নির্দল প্রার্থীদের নিজেদের দলে টেনে।
গুপকার জোটের সব দলগুলির মধ্যে একতা কত দিন বজায় থাকবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ভুললে চলবে না, দশকের পর দশক যারা পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার চালিয়ে গিয়েছে তারাই আজ একসঙ্গে জোট বেঁধেছে। ফলে সব সময়ই তা ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়। আর তেমন কিছু হলে বিজেপি বনাম বিজেপি বিরোধী জোট- এই সরল সমীকরণটিও ভেঙে যাবে। তেমন কিছু হবে কিনা তা অদূর ভবিষ্যৎই বলবে। আপাতত প্রধানমন্ত্রীর বৈঠককে ঘিরে আরও একবার আলোচনায় উঠে এসেছে কাশ্মীর প্রসঙ্গ ও গুপকার জোট। দু’টিই এই মুহূর্তে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে। এই মুহূর্তেই যদি বিধানসভা নির্বাচন হয়, তাহলে কি তারা জিততে পারবে? নাকি বিজেপিই শেষ হাসি হাসবে? এই প্রশ্নও কঠিন। উত্তরও জানা নেই। কেবল নানা রকম অঙ্কের সম্ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। নিঃসন্দেহে যে অঙ্কের গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর কাশ্মীরের প্রধান বিরোধী দলগুলির এই জোট ও তাদের মধ্যে তৈরি হওয়া সমঝোতা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.