ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: তিন দফা শেষ। ধীরে ধীরে ভোটের আগুনে সেঁকে তপ্ত হচ্ছে কলকাতা। এ গলি-ও গলি ছেয়ে গিয়েছে পতাকা-পোস্টার। তৃণমূলের প্রার্থীর ছবির গায়েই হেলান দিয়ে দাঁড় করানো বিজেপি প্রার্থীর ছবি। দেওয়ালে দেওয়ালে লড়াই। এক ইঞ্চি জমি ছাড়া নয়। গ্রীষ্মে পুড়ছে শহরের পিচ। তারই মাঝে ৫০তম প্রতিষ্ঠাদিবসের কর্মসূচি সেরে তিন দফায় নোটায় ভোটপর্ব সেরে ফেলল নকশালদের একটি ভাগ।
এরা নিউ ডেমোক্রেসি। নকশালপন্থীদের অন্যতম একটি শাখা। সংগঠন বলতে বাঁকুড়া আর বালুরঘাট। তা-ও স্রেফ বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরেই তাদের একমাত্র প্রার্থী। তরণী রায়। এর বাইরে রাজ্যে তাদের সেভাবে সংগঠন না থাকায় সেসব জায়গায় কর্মীদের নোটায় ভোট দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানালেন সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক সুশান্ত ঝা। ব্যস এটুকুই। এর বাইরে ভোট নিয়ে কোনও আগ্রহ তাদের নেই। উত্তর কলকাতার ১০২ নম্বর সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডে তালতলা মোড় থেকে ধর্মতলার দিকে কিছুটা এগোতেই ডান হাতে দোতলা পুরনো বাড়ি। রাস্তার উপর দোতলা বারান্দার গায়ে ঝুলছে জীর্ণ বোর্ড। লালের উপর সাদা রংয়ে লেখা সিপিআই (এম-এল)। ১৯৭৮ থেকে কলকাতায় নকশালদের এটাই প্রথম পার্টি অফিস। এখন নিউ ডেমোক্রেসির।
দোতলায় রাস্তার ধারে লম্বাটে একখানা ঘর। তার ছোট একফালিকে বানানো হয়েছে বিশ্রামকক্ষ। চারু মজুমদারের কালো-সাদা দীঘল ছবি। লাগোয়া বারান্দায় এক ছিটে রান্নাঘর। বাকি অংশের আরও একফালিতে অফিস ঘর। সারি সারি সাজানো লাল মলাটের বই। ফোনে আরও কিছু বই ছাপানোর ফিশফিশানি হিসাব। মাঝেমাঝে জরুরি কিছু ফোন। ঘরে কিছু অভ্যস্ত আসবাবের মধ্যেই দেওয়াল ঘেঁষে জোড়া কালো টেবিলের উপর কাচ বসানো। দু’পাশে চেয়ার। পরপর একপাশে টাঙানো ইলেকট্রিকের বিল। তারই গা বেয়ে উঠেছে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও সেতুংদের বিবর্ণ ছবি। পাশে পাশে সোনার জল করা নাম। উপরে দেওয়ালের দু’পাশে একদিকে স্তালিন, অন্যদিকে মাও। ডিসি ফ্যানের হাওয়া ছাড়িয়ে ছাদে চোখ উঠতেই কড়ি-বরগার সার।
আপনাদের পার্টি কি নিষিদ্ধ? “মোটেই না”– জানালেন সুশান্তবাবু। ২২ এপ্রিল ছিল লেনিনের জন্মদিন। ওইদিনই পার্টির ৫০তম প্রতিষ্ঠাদিবসও গিয়েছে। কলকাতায় বড় করে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হয়েছে। মৌলালি যুবকেন্দ্রের সেই অনুষ্ঠানে পাঞ্জাব, দিল্লি, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে এসেছিলেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। ছিলেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরাও। সেই আয়োজন ছিল বলেই এত ব্যস্ততা বলে জানালেন নিউ ডেমোক্রেসির রাজ্য নেতৃত্ব। এর বাইরে ষষ্ঠ দফায় ১২ মে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে তাদের প্রার্থীর লড়াই। তাই ব্যস্ততাও সেটুকু নিয়েই।
নকশালদের অন্য দুই শাখা সিপিআইএমএল (লিবারেশন) ও সিপিআইএমএল (লিবারেশন রেডস্টার)-এরও সংগঠন বাংলার ঘাটিতে খুব মজবুত নয়। তাদের প্রার্থী বাদে অন্যত্র যদিও তারা দুই শাখাই সিপিএমকে সমর্থনের কথা জানিয়েছে। নিউ ডেমোক্রেসির সঙ্গে রেডস্টারের গোল বেধেছে এখানেই। বিষ্ণুপুরে নিউ ডেমোক্রেসির বিরুদ্ধেই প্রার্থী দিয়ে বসেছে রেডস্টার। বেজায় চটেছে নিউ ডেমোক্রেসি। তরণী রায় আগের ভোটে একই আসনে রেডস্টারের প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু সেখানে নিউ ডেমোক্রেসির মজবুত সংগঠন রয়েছে বলেই এবার দল বদলে তরণীবাবু তাদের প্রার্থী হয়েছেন বলে দাবি সুশান্তবাবুর। রেডস্টারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে তিনি বলছেন, “বিষ্ণুপুরে রেড স্টারের কোনও সংগঠন নেই। আমরা অনুরোধ করেছিলাম। তার পরও আমাদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিল।” কেন? নিউ ডেমোক্রেসি নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, ভাঙড় আন্দোলনে রেডস্টারের অলীক চক্রবর্তীদের সমর্থন দেননি তাঁরা। সুশান্তবাবুর কথায়, “সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় চলে গেল রেডস্টার। আমরাও সমর্থন তুলে নিলাম। তার জেরেই বিষ্ণুপুরে আমাদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছেন অলীকরা।”
এর বাইরে রেডস্টার এবার গোটা দেশে ৪৩টি কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়েছে। সিপিআইএমএল (লিবারেশন) এ রাজ্যে কৃষ্ণনগর ও হুগলিতে ভোটে লড়ছে। বাকিগুলিতে সিপিএমকে সমর্থন করবে বলে জানিয়েছেন দলের নেতা পার্থ ঘোষ। ভিনরাজে্যর মধ্যে বিহারের আরা, ছাপরা, গয়া, ঝাড়খন্ডে একটি কেন্দ্র-সহ ওড়িশা, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানায় প্রার্থী দিয়েছে তারা। এটাই আপাতত বাংলা শুধু নয়, দেশজুড়ে নকশালদের নির্বাচনী অবস্থান। বিভিন্ন জায়গায় শাখা থেকে প্রশাখায় ছড়িয়ে রয়েছেন নকশালরা। কোথাও কোথাও কিছু ইসু্যর ভিত্তিতে টুকরো হয়েছে মতাদর্শ। মাওবাদীরা রাষ্ট্রশক্তির বিরোধী। দেশজুড়ে ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছে তারা। এ রাজ্যে তাদের সংগঠন নেই বলেই জানিয়েছে শীর্ষ নেতৃত্ব। অন্য রাজ্য যেমন ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে তাদের সংগঠন রয়েছে। সেখানে তারা ভোট বয়কটের প্রচার করতে পারলেও, এ রাজ্যে তা সম্ভব হচ্ছে না। তাদেরও কয়েকজন নেতা আবার ভিন রাজ্যেও প্রচারে যাচ্ছেন বলে খবর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.