ছবি: প্রতীকী
শুভঙ্কর বসু: পশ্চিমবঙ্গে টাকা দিয়ে ভোট কেনা হয় না। অতীতেও তেমন কোনও নজির নেই। দিল্লিতে প্রথম দফার নির্বাচনী প্রশিক্ষণের পর পর্যবেক্ষক ও আয়কর দপ্তরের হাতে নির্বাচন কমিশন যে রিপোর্ট তুলে দিয়েছে, তাতে এমন তথ্যই উঠে এসেছে বলে সূত্রের খবর। জানা গিয়েছে, গোটা দেশে এবার ১১০টির বেশি কেন্দ্র ‘আর্থিকভাবে স্পর্শকাতর’ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। যে তালিকায় এ রাজ্যের কোনও কেন্দ্র নেই। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও এই ‘আর্থিক স্বচ্ছতা’-র তালিকায় রয়েছে কেরল এবং দিল্লি-সহ বাকি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির নাম।
আইনশৃঙ্খলার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত বুথকে স্পর্শকাতর ঘোষণার দাবিতে যখন রাজ্যের শাসক-বিরোধী তরজা তুঙ্গে, ঠিক তখন বাংলার ভোট নিয়ে কমিশনের এই ‘শংসাবার্তা’ নিঃসন্দেহে রাজ্যের সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছে স্বস্তির খবর। অন্তত তেমনটাই মনে করছে বিশেষজ্ঞমহল।
পশ্চিমবঙ্গের নাম না হয় নেই। আর্থিক স্পশর্কাতর তালিকায় আছে কারা? আর্থিকভাবে স্পর্শকাতর বা ‘এক্সপেনডিচার সেনসিটিভ’ রাজ্যের তালিকার শীর্ষে রয়েছে তামিলনাড়ু, গুজরাত ও তেলেঙ্গানা। এই তিনটি রাজ্যের সব কেন্দ্রেই টাকা দিয়ে ভোট কেনাবেচার আশঙ্কা রয়েছে বলে আয়কর দপ্তর ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সতর্ক করে দিয়েছে কমিশন। পাশাপাশি অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, বিহার ও উত্তরাখণ্ডের প্রায় ৭০ শতাংশ কেন্দ্রকে এবার অর্থিকভাবে স্পর্শকাতর হিসাবে দেখছে কমিশন। রিপোর্ট অনুযায়ী, অন্ধ্রপ্রদেশের মোট ২৫টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ১৬টি কেন্দ্র অর্থিকভাবে স্পর্শকাতর। বিহারের ৪০টি কেন্দ্রের মধ্যে ২১টি। এছাড়াও কর্নাটকে ২৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২টি এবং উত্তরাখণ্ডে ৫টি কেন্দ্রের মধ্যে চারটি কেন্দ্রে কমিশনের নজর রয়েছে। আশঙ্কা যেখানে ভোটের বিনিময়ে টাকার লেনদেন হতে পারে। উত্তরপ্রদেশে সব দলের প্রার্থী তালিকা দেখার পর কমিশন আর্থিক স্পর্শকাতর কেন্দ্র বাছবে।
টাকা দিয়ে ভোট কেনাবেচা রুখতে নির্বাচন কমিশন কিন্তু বদ্ধপরিকর। দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে প্রথম ও দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের জন্য প্রশিক্ষণ পর্বে যোগ দিয়েছিলেন প্রায় ১৮০০ অবজারভার। সেখানে তাঁদের এটা স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কমিশনের আশঙ্কা, লোকসভা ভোটে বিভিন্নভাবে টাকার ব্যবহার হতে পারে। পর্যবেক্ষকদের তাই সবরকমভাবে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। আর্থিকভাবে স্পর্শকাতর কেন্দ্রগুলির জন্য এবার বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে কমিশন। কেন্দ্রগুলিতে একজন অতিরিক্ত আর্থিক পরিদর্শক নিয়োগ করা হয়েছে। রাখা হচ্ছে অতিরিক্ত ফ্লাইং স্কোয়াড, স্ট্যাটিক সারভিলিয়েন্স টিম, ভিডিও সারভিলিয়েন্স টিম।
কীসের ভিত্তিতে এবার আর্থিকভাবে স্পর্শকাতর বুথ চিহ্নিত করা হয়েছে?
অতীতে ভোট কেনাবেচার ইতিহাস রয়েছে, কিংবা আগে যেসব কেন্দ্রে বিপুল অর্থ খরচ হয়েছে বা ভোট কেনাবেচার অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারদের বলা হয়েছিল সেই কেন্দ্রগুলি চিহ্নিত করতে। তারপর আয়কর কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে চিহ্নিত হয়েছে আর্থিকভাবে স্পর্শকাতর বুথের তালিকা। “পশ্চিমবঙ্গে টাকা দিয়ে ভোট কেনা-বেচার ইতিহাস বিরল। অতীতে তেমন কোনও বড় ঘটনার নজির নেই। এমনকী এই ধরনের অভিযোগের সংখ্যাও নিতান্তই নগণ্য। তাই পশ্চিমবঙ্গ স্থান পেয়েছে স্বচ্ছতার তালিকায়।”–জানিয়েছেন কমিশনের এক আধিকারিক।
তথ্য অনুযায়ী ২০১৪-র লোকসভা ও ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্য থেকে বিপুল অর্থ উদ্ধারের কোনও ঘটনা ঘটেনি। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে আচরণবিধি লাগু হওয়ার পর থেকে গোটা নির্বাচনী পর্বে মোট ৭ কোটি ৮০ লক্ষ ৫ হাজার ২০ টাকা সিজ করা হয়েছিল। যার মধ্যে তথ্য যাচাই করার পর ৪ কোটি ৮৩ লক্ষ ৭১১ টাকা ফিরিয়েও দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও গত লোকসভা নির্বাচনগুলিতে সব রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা হলফনামা দিয়ে যে খরচের হিসাব দাখিল করেছিলেন তাতে দেখা যাচ্ছে এক জন প্রার্থী সর্বোচ্চ ৭০ লক্ষ টাকা খরচের অনুমতি থাকলেও এ রাজ্যের ভোটগুলিতে গড়ে খরচ হয়েছে ৬৫ লক্ষ টাকা।
অতীতে টাকা দিয়ে ভোট কেনাবেচার তেমন নজির না থাকলেও রাজ্যে একাধিক হাওয়ালা চক্র সক্রিয় রয়েছে। পাশাপাশি কালো টাকা পাচারের ক্ষেত্রে রাজ্যকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে ব্যবহার করা হতে পারে বলে আশঙ্কা কমিশনের। সে কারণে বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা চালু রেখেছে কমিশন। আয়কর আধিকারিকদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে প্রতিটি জেলায় নজরদারির কাজ চলছে। কয়েক দিন আগেই আলিপুরদুয়ারে চার ব্যক্তির কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে ৫৫ লক্ষ টাকা। এছাড়াও কলকাতার বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট থেকে ৬০ লক্ষ টাকা-সহ ধরা পড়েছে দীনেশ লোহিয়া নামে এক ব্যক্তি। তাছাড়া ভোট ঘোষণার আগে ৯ মার্চ নিউ মার্কেট এলাকায় এক ব্যক্তির থেকে মিলেছে ৮৭ লক্ষ টাকা। কিন্তু এই সব অর্থের সঙ্গে ভোটের কোনও যোগ এখনও মেলেনি বলে জানা গিয়েছে।
কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন ঘোষণার পর কোনও ব্যক্তি বৈধ কাগজ ছাড়া একলপ্তে নগদ ৫০ হাজার টাকা সঙ্গে রাখতে পারেন। ৫০ হাজারের বেশি অর্থ সঙ্গে রাখলেই রাখতে হবে বৈধ কাগজ পত্র। সর্বোচ্চ নগদ ১০ লক্ষ পর্যন্ত এই নিয়ম। একলপ্তে ১০ লক্ষের বেশি টাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আয়কর দপ্তর ও নির্বাচন কমিশনের অনুমতি নিতে হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.