সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ইতিহাস বদলাল উত্তরপ্রদেশ (Uttar Pradesh)। ৩৫ বছরের রীতি ভেঙে পরপর দু’বার সরকার গড়ল একই দল। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার বিপুল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়ছে বিজেপি (BJP)। তিনশো না পেরোক, আড়াইশোর বেশি আসনে পদ্ম ফুটিয়েছেন যোগী আদিত্যনাথ (Yogi Adityanath)। নিজেও জিতেছেন বিপুল ভোটে। অথচ ভোটের আগেই দেশের সবচেয়ে বড় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই ক্ষোভের ঝড় বয়ে যেতে দেখা গিয়েছে। তবু সেই ক্ষোভের প্রভাব পড়ল না ভোটবাক্সে! কোন ম্যাজিকে লখনউয়ের তখতে ফিরলেন যোগী? শুধুই বিজেপির ভোট ম্যানেজমেন্ট নাকি এই জয়ের পিছনে রয়েছে বিরোধীদের সংগঠনের চরম দুর্বলতা?
প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার সময় পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট বলছে, উত্তরপ্রদেশে (UP Elections Result) বিজেপি জিতেছে ২৫টি আসনে। বড় ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছে আরও ২২৬টি আসনে। তাদের জোটসঙ্গী আপনা দল এগিয়ে রয়েছে আরও ১১টি আসনে। গতবার বিজেপির ঝুলিতে এসেছিল ৩২৫টি আসন। সেদিক থেকে বিচার করতে হলে এবার সত্তরের বেশি আসন খুইয়েছে গেরুয়া শিবির। সেই তুলনায় নিজেদের আসন সংখ্যা আড়াই গুণ বাড়িয়েছে অখিলেশ যাদব নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী পার্টি। তাদের ঝুলিতে এসেছে ১১৭টি আসন। সঙ্গী নিষাদ দল পেয়েছে ৭টি আসন।
গতবার কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে সপা (SP) জিতেছিল মোটে ৪৭টি আসন। তার মধ্যে কংগ্রেস (Congress) পেয়েছিল ৭টি আসন। এবার প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর নেতৃত্বে হাত শিবির মোটে ২টি আসনে জিতেছে। তথৈবচ অবস্থা মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টিরও (BSP)। ২০১৭ সালে তারা পেয়েছিল ১৯টি আসন। এবার মোটে একটি কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন বসপা প্রার্থী।
গত ৫ বছর ধরে উত্তরপ্রদেশে কখনও ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে দলিতদের উপর অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছে তো কখনও আবার গেরুয়া শিবিরের মন্ত্রীর ছেলের গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়েছেন আন্দোলনকারী কৃষকরা। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্ষণের মর্মান্তিক খবরও সামনে এসেছে। করোনায় মৃত্যুর তথ্য লুকোতে গঙ্গায় দেহ ভাসানোর অভিযোগও উঠেছিল বিজেপির বিরুদ্ধে। তার পরও ভোটবাক্সে সেই ক্ষোভের কার্যত কোনও প্রতিফলনই হল না। লখিমপুর খেরি, হাথরাসের মতো এলাকাতেও প্রায় সব আসন জিতে নিলেন মোদি-যোগীর জুটি। কিন্তু কেন? কোন সমীকরণে উত্তরপ্রদেশের ‘উপযোগী’ হয়ে উঠলেন যোগী?
উত্তরপ্রদেশের সামাজিক সমীকরণটা বরাবরই জটিল। কোথাও দলিতদের শক্ত ঘাঁটি তো কোথাও আবার গভীরে রয়েছে জাঠদের শিকড়। কোথাও উচ্চজাতের ব্রাহ্মণকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা চালাতে হয় তো কোথাও আবার ক্ষত্রিয়দের ভোট টানতে কষতে হয় অন্য অঙ্ক। এই জটিল সমীকরণটা জলবৎ তরলং করেছে বিজেপি। তাই ভোটের মুখে একের পর এক দলিত নেতা বেরিয়ে গেলেও পদ্মের ভোটব্যাংক অটুট রয়েছে। যতটুকু ভোট সাইকেলের ঝুলিতে স্থানান্তরিত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ভোট মায়াবতীর ঝুলিতে থেকে এসেছে গেরুয়া শিবিরে। কাঠখোট্টা অঙ্কের হিসেব বলছে, গতবার বসপার (BSP) প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ২২.২৩ শতাংশ। এবার তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২.৭৮ শতাংশ। আবার বিজেপির ভোট শতাংশ ৩৯.৬৭ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১.৯৯ শতাংশ। ইতিহাস গড়ে সপার ঝুলিতে এসেছে ৩১. ৭৬ শতাংশ। এই প্রথমবার ৩০ শতাংশ ভোটের গণ্ডি পেরল সাইকেল।
গোবলয়ের রাজনীতি বরাবরই জাতপাত ভিত্তিক। উত্তরপ্রদেশে সেই সমীকরণ যেন আরও স্পষ্ট। এবারও হিন্দুত্বের চোরা হাওয়া ছিল রাজ্যে। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ সেই হাওয়াকে বিজেপির পালে পৌঁছে দিয়েছিল। আবার সম্প্রতি বারাণসীর মেকওভার করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। হিন্দু ভোটব্যাংকে প্রভাব ফেলেছে এই পদক্ষেপও। তার উপর যোগ হয়েছিল মোদি-যোগী যুগ্ম ক্যারিশমা। প্রধানমন্ত্রীর ‘ইউপির জন্য উপযোগী যোগী’ স্লোগানও প্রভাব ফেলেছে বলেও মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
২০২০ সালের মার্চ থেকে করোনা কাঁটায় বিদ্ধ গোটা বিশ্ব। এমন পরিস্থিতিতে পরিযায়ী শ্রমিক থেকে চাকরি হারানো, একের পর এক সমস্যায় বিদ্ধ হয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। আঁচ পড়েছে উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারের উপরও। রাজ্যবাসীর পেট চালাতে পরিবারের মাথা পিছু ১০ কেজি করে চাল বিলি করেছিল যোগী সরকার। এরকম একাধিক প্রকল্প ছিল যোগী সরকারের। ভোটবাক্সে সেই সমাজকল্যাণমুখী প্রকল্পের সুবিধা পেল গেরুয়া শিবির। সমাজের একেবারে নিম্নস্তরের মানুষ দু’হাত তুলে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে।
উত্তরপ্রদেশে গলিতে গলিতে গজিয়ে উঠেছে অপরাধীদের আড্ডা। খুন-জখম-রাহাজানি-ধর্ষণ যেন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। যোগীর আমলে সেই অপরাধের সংখ্যা না কমলেও বেড়েছিল অপরাধীদের সাজা দেওয়ার পরিমাণ। পুলিশকে খোলা হাত দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। তাই দ্রুত শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা যাচ্ছিল সেখানে। আর যোগীর এই পদক্ষেপে বেজায় খুশি ছিলেন আমজনতা।
তবে শুধু বিজেপির ক্যারিশমা নয়, গেরুয়া শিবিরের এই চোখ ধাঁধানো ফলাফলের পিছনে কিছুটা মায়াবতীর নিষ্ক্রিয়তাও দায়ী। এবার হারার আগে কার্যত হেরে বসেছিলেন বসপা নেত্রী। ফলত তাঁদের দখলে থাকা দলিত ভোটের বড় অংশ টেনে নিয়েছে বিজেপি। আর এই ভোট কাটাকাটির অঙ্কে ব্যাপক সুবিধা পেল গেরুয়া শিবির। ফলস্বরূপ আরও ৫ বছর যোগীরাজ দেখবে উত্তরপ্রদেশ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.