ভাস্কর লেট, এলাহাবাদ: ‘একথালা সুপারি গুনতে নারে ব্যাপারি।’ আকাশময় তারাদের ঝিকিমিকি। এইভাবে ধাঁধার পুরে ভরে ছোটবেলায় ঠাকুমা শোনাত। বুধবার কাকভোরে, অর্ধকুম্ভের প্রথম শাহিস্নানের ব্যাপকতার সামনে পড়ে আমারও বিলকুল তেমনই ‘বাঁশবনে ডোম কানা’ অবস্থা হল। এত মানুষ, জীবনের এত উচ্ছ্বাস ও রং, যেন মনে হচ্ছিল হাজার হাজার তারাশোভিত আকাশটাই মাটিতে নেমে এসেছে টুপ করে। জলের ঢেউয়ে কাঁপছে আজন্মলালিত বিশ্বাস।
যে বিশ্বাস ঠাকুরদার থেকে বাপ পেয়েছিল একদিন। আবার একদিন বাপের থেকে ছেলে পাবে। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রত্যয় ও ভাবনার হাতফেরতা হওয়ার এই কাহিনি কোথাও না-লেখা থেকেও আবহমানের অংশ হয়ে যাবে। বলা হচ্ছে, দেড় থেকে দু’কোটি লোকসমাগম হবে আজকের দিনে। মঙ্গলবার বেলা আটটার মধ্যেই লাখ লাখ মাথার ভিড়। এলাহাবাদ ফোর্ট যমুনার একদম পাশে। সেখান থেকে দেড় কিলোমিটার পিছিয়ে এলে পড়বে ‘ল্যায়টে হুয়ে হনুমানজি’র মন্দির। একমাত্র হনুমান মন্দির, যেখানে পবনপুত্র শায়িত অবস্থায় রয়েছেন। মানুষের মুখে মুখে যে গল্পটা ঘোরে, তা হল: লঙ্কা দহন করে ফেরার পথে হনুমানজি এখানে বিশ্রাম নেওয়ার অছিলায় একদফা গড়িয়ে নিয়েছিলেন। বর্ষায় সে মন্দিরে জল ঢুকে যায় প্রতিবার। এটা নিয়েও অনবদ্য লোকবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। স্থানীয়রা মনে করেন, হনুমানজিকে স্নান করাতেই মা গঙ্গা যেচে পড়ে এগিয়ে আসেন এতটা, ও প্লাবিত করেন জনভূমি।
এই ‘ল্যায়টে হুয়ে হুনুমানজি’-র মন্দিরের পাশ দিয়ে পিলপিলিয়ে জনস্রোত বয়ে যাচ্ছে। বাপের কাঁধে চড়ছে ছেলে। হাতে বাপেরই মোবাইল। খেলাচ্ছলেই কাউকে ফোন করার ভঙ্গি করছে ছেলেটি। যাবে সে স্নান করতে। পাশে ক্রাচ হাতে সাধুজি হাঁটছেন। বাঁ পা হাঁটুর নিচ থেকে অ্যামপুট করা। তিনিও স্নান করতেই যাচ্ছেন বিপুল উদ্যমে, উৎসাহে। আরেকজনকে পেলাম। তিনি সর্বত্যাগী সাধু নন, ব্যবসায়ী। ডানহাতের পাঁচটা আঙুলে আটটা আংটি অন্তত। তিনটে যে খাঁটি সোনার, দেখেই মালুম হল। চোখে সানগ্লাস। বনেদি চেহারা, তপতপে রং। মাঝবয়সের মানুষটির যে আর্থিক সমৃদ্ধি ভালই, বুঝতে কষ্ট হয় না। তিনিও হাতড়াচ্ছেন নানা মানুষকে জিজ্ঞেস করে সঙ্গমে যাওয়ার পথ। স্নান করতে হবে যে! কলেজ পড়ুয়া আধুনিকা দুটি মেয়ে এসেছে পরিবারের সঙ্গে। নিজেদের ভিতর কথা বলার সময়ও ইংরেজির ফুলঝুরি। তবে স্নানের ব্যাপারে এখনও তারা সনাতন ভারতচেতনায় ভরপুর। বিশ্বাস করে, সূর্যোদয়ের মুহূর্তে ‘শাহিস্নান’ মানেই অমৃতকুম্ভের আশিস পাওয়া। নদীর পাশে পাশে ব্যারিকেড করে দিয়েছে জলপুলিশ। ওই ব্যারিকেডের ওপারে জলের গভীরতা ও গাম্ভীর্য বেশি। নিরাপত্তারক্ষীরা টহল দিচ্ছেন এবং অহরহ চলছে বাঁশিতে ফুঁ। ব্যারিকেডের বেষ্টনীর মধ্যেই ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে হইহই করে সবাই আলিঙ্গন করছে পুণ্যভূমির জল।
দুটি বিষয়ে প্রশাসনের অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেই হয়। প্রথমত, মেলা চত্বর যত বড়, পরিচ্ছন্নতার বহরও তত বেশি। এলাকা বড় হলে সাফাইয়ে শৈথিল্য আসে। অর্ধকুম্ভ সেদিক থেকে মস্ত ব্যতিক্রম। ভোর সাড়ে তিনটেয় দেখলাম ঝাঁটা পড়ছে, মেলাপ্রাঙ্গনে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা জলের বোতল বা একপাটি চটি, সে যাই হোক না কেন, তুলে ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছেন সাফাইকর্মীরা। বেলা এগারোটার সময়ও একই চিত্র। দ্বিতীয়ত, চারিদিক পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। গঙ্গার বুকে অনেকগুলি অস্থায়ী পল্টন ব্রিজ বানানো হয়েছে। কিন্তু সবগুলি দিয়ে লোক যেতে বা আসতে পারবে না। পুলিশরা বলে দিচ্ছেন, সামনে গিয়ে ডাইনে বেঁকে যান। ন’নম্বর ব্রিজ পাবেন। ওটা দিয়ে পারাপার করুন। বাকি ব্রিজ বন্ধ আছে।
এইবারের কুম্ভে রূপান্তরকামীদের আখড়া হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে একজায়গায় দেখা মিলল পনেরো জন রূপান্তরকামীর। চোখে চোখ পড়তেই একজন বলে উঠলেন, ‘জয় শ্রীরাম!’ তাঁর দিকে ফিরতি হাসি ফিরিয়ে দিয়েই মনে হল- রূপান্তরের বাসনা কার মনে না নেই? ‘রূপান্তর’ মানে তো এক স্তর থেকে অন্য স্তরে উত্তীর্ণ হওয়া। সেই চলমানতার মধ্যেই বেঁচে থাকার সার্থকতা। এই যে অফুরন্ত মানুষের মেলা, এই যে অপরিসীম আনন্দধারা, এই যে উদযাপনের আরকে মন্থিত হতে হতে একের পর এক অবগাহন হয়ে চলেছে- এও তো অন্য কোনও অস্তিত্বের ছায়াপথে রূপান্তরিত হতে পারার জন্যই। এই রূপান্তরকামী মনই পরের বারের কুম্ভকে নতুন করে সম্ভব করে তুলবে, সাজিয়ে তুলবে মাহাত্ম্য।
Experience the Grandeur of Shahi Snan, Experience Kumbh. #ChaloKumbhChalein #KumbhMela2019 #DivyaKumbh #BhavyaKumbh #ShahiSnan @PrayagrajKumbh @CMOfficeUP @UPGovt pic.twitter.com/pRg1z5tOHR
— Information and Public Relations Department, UP (@InfoDeptUP) January 15, 2019
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.