সোম রায়, তুরতুক (জম্মু ও কাশ্মীর): ‘ড্যাডি, পাকিস্তান দেখব।’ দেশের উত্তরতম প্রান্তে এসে আধো গলায় বাংলা শুনে কানের বিস্ময় কাটছিল না। মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম পাশেই বসে তিন সদস্যের এক পরিবার। আলাপ হল। ভদ্রলোকের নাম দীপ্তেন্দু গোস্বামী। ইন্দোরের প্রবাসী বাঙালি। স্ত্রী পূজা ও বছর সাতেকের ছেলে ঈশানকে নিয়ে ছুটি কাটাতে লাদাখ এসেছেন। শহর কলকাতা থেকে প্রায় ২,৭১০ কিলোমিটার দূরে যে জায়গায় এসে আলাপ হল বাঙালি পরিবারের সঙ্গে, সেই গ্রামের নাম তুরতুক।
লে-র হোটেল থেকে ভোর পাঁচটায় রওনা দিয়ে ২০০ কিলোমিটারের উপর পাহাড়ি পথ পেরিয়ে যখন এসে পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে বেলা ১২টা। মাঝে রাস্তার দু’পাশে অপূর্ব মনোরম দৃশ্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে পাশে সরিয়ে রেখে পাঠকের মনে হতেই পারে, কী এমন আছে এখানে, যে জন্য এতটা পথ ঠেঙিয়ে আসা? গ্রামটির সঙ্গে দু’টি এমন বিষয় জড়িয়ে, যা শুনলে মনে হবে ছ’ঘণ্টা কেন ওই গ্রামে যেতে ১২ ঘণ্টাও জার্নি করা যায়। প্রথমত, দেশের উত্তরতম প্রান্তে শেষতম গ্রাম তুরতুক, যেখানে সাধারণ নাগরিক প্রবেশ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই গ্রাম ও ভারতীয় মানচিত্রে অবস্থিত এর উত্তরদিকের গোটা এলাকা ছিল পাকিস্তানের দখলে। পূর্ববঙ্গে যেদিন মুক্তিযুদ্ধের পর এল বিজয় দিবস, ঠিক সেই ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনার এক গোর্খা রেজিমেন্টের দাপটে পড়ি কী মরি করে পাক সেনা পালায় সীমানার ওপারে।
এমন এক গ্রামে, না এসে থাকা যায়? তাও আবার এমন সময়ে যখন দেশজুড়ে চলছে গণতন্ত্রের বৃহত্তম উৎসব। তুরতুক গ্রামের যে হাজার দেড়েক লোক ভারতের সরকার গঠনে আগামিকাল নিজেদের মতামত দেবেন, তাঁদের অনেকেরই যে জীবনের শুরু হয়েছে পাকিস্তানে। কেউ আবার ভারতে জন্মে মাঝে দু’যুগ পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে কাটিয়ে আবার পেয়েছেন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের নাগরিকত্ব। জম্মু-কাশ্মীরে আগের দু’দফায় একটা অভিজ্ঞতা ভালই হয়েছে। টুরিস্টদের জন্য খাতিরই আলাদা। তবে প্রান্তিক এলাকার নিরীহ বেশিরভাগ মানুষ সংবাদমাধ্যমের উপর বিরক্ত। বিশেষ করে সর্বভারতীয় কিছু চ্যানেল, যারা ‘জন্নতের নামে অহেতুক অপপ্রচার চালায় তাদের উপর। এই মানুষগুলির কাছে সর্বভারতীয় চ্যানেল আর বাংলা সংবাদপত্রের খুব একটা পার্থক্য নেই। তাই ঠিক করলাম, প্রেস কার্ডটা পকেটেই থাক। ‘পরিচয় গুপ্ত’ হয়ে থাকি।
হপ্তাদুয়েক আগে উরি গিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে চরম সমস্যায় পড়েছিলাম। কাকুতি-মিনতি করেও গ্রামে প্রবেশের ছাড়পত্র পাইনি। এবার তাই তুরতুক পার করে এলওসি-র সওয়া দু’কিলোমিটার আগে অবস্থিত থাং গ্রামে ঢুকতে গিয়ে সেই ভুল করিনি। টুরিস্টের মতোই চেকপোস্টে পাসপোর্ট জমা করে চলে যাই থাংয়ের কাছে। সেখানে সেনার পক্ষ থেকে নিজেদের ও শত্রুপক্ষের দখলে থাকা বিভিন্ন শৃঙ্গ, ক্যাম্প, বাংকার দূরবিন দিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা আছে। হিসেবমতো থাং গ্রামই উত্তরতম প্রান্তের গ্রাম। কিন্তু, এখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। ২৭ পরিবারের প্রায় ৩০০ লোকের বাস। তাঁদের জন্য সামনেই বসবে পোলিং স্টেশন। এইভাবেই পরিচয় গোপন রেখে একটু আগে তুরতুক গ্রামের একদম মুখের চায়ের দোকানে স্থানীয়দের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া শুরু কলকাতা থেকে আসা ‘টুরিস্ট’-এর। সঙ্গী ড্রাইভার সোমো দোর্জি। সেখানেই আলাপ প্রবাসী সেই বাঙালি পরিবারের সঙ্গে। গ্রামের একদিকে আঙুল তুলে বছর পনেরোর এক ছোকরা বলল, “ওদিকে আমাদের মসজিদ। ওখানে যান, অনেক বুডঢা পেয়ে যাবেন, যাঁরা সেই সময়টা দেখেছেন। সেইসব কথা আমাদেরও মাঝে মাঝে তাঁরা আওড়ান।”
মসজিদ যাওয়ার পথেই কাঠের ব্রিজে রোদ পোহাতে দেখলাম এক বৃদ্ধাকে। নাম মারিয়া। বিয়ে করে এই গ্রামে এসেছেন অর্ধশতাব্দীরও আগে। স্থানীয় বালতি ও উর্দু মিশিয়ে বলছিলেন, “আমার শ্বশুরমশাই তখন অসুস্থ। তাঁকে নিয়ে ভাসুর লাহোর যায়। ওখানে আত্মীয় থাকে। একদিন সকালে হঠাৎ শুনলাম আমরা আর পাকিস্তানি নয়, ভারতীয়। ওরা আর ফিরতে পারেনি। কাঁদতে কাঁদতে শাশুড়ি তিনমাসের মধ্যে মারা গেল। শ্বশুর ও ভাসুর কেউ মাটি দিতে পারল না। কত কষ্ট বলুন তো?” আপনি এই দুই দেশেরই রাজত্ব দেখেছেন। কারা ভাল? “দেখুন আমি মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ। অতশত বুঝি না। তবে আমার মিঞা আর ছেলেরা বলে ইন্ডিয়াই ভাল।” বৃদ্ধা মারিয়ার শাশুড়ির পরিণতির কথা শুনে মন কেমন ভারী হয়ে গেল। পরক্ষণেই ‘টুরিস্ট’ আবেগকে শাসন করে উঠল সাংবাদিক সত্তা। এখনও যে কাজ অনেক বাকি। তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফিরতেও হবে। এমনিতে ভোরে বেরিয়ে রাতের মধ্যে লে ফিরতে হবে বলে অনেক কষ্টে প্রায় হাত-পা ধরে রাজি করানো গিয়েছে ড্রাইভার সোমো দোর্জিকে। অন্তত হাফ ডজন ড্রাইভার এই প্রস্তাব একেবারে হুক মেরে স্টেডিয়ামের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেকের বক্তব্য, ‘অসম্ভব! পাহাড়ি রাস্তায় দুশো কিলোমিটার গিয়ে আবার ফেরা নো চান্স।’ প্রথমত, তারা দু’দিন মিলিয়ে যে ভাড়া হাঁকছিল, তা বিশাল। তার উপর রবিবার ভোরে রওনা দিতে হবে শ্রীনগরের দিকে। তাই নাইট স্টে কিছুতেই সম্ভব নয়।
মারিয়ার কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হাঁটতে লাগলাম মসজিদের দিকে। কিছুটা যেতেই দেখা পেয়ে গেলাম আব্দুল কাদির ও মহম্মদ জাহিদ নামক দুই বৃদ্ধকে। দু’জনের গল্প দু’রকম। মা-র সঙ্গে ছোটবেলায় মামাবাড়ি ঘুরতে তুরতুক এসেছিলেন জাহিদ। এক সকালে ঘুম থেকে উঠে জানতে পারেন-এই গ্রাম আর পাকিস্তানে নেই। তারপর থেকে কোনওদিন মা-বাবার মুখ দেখা হয়নি তাঁর। বলেছিলেন, “এরকম কপাল যেন কোনও সন্তানের না হয়। যদিও মামু আমাকে নিজের ছেলের মতো বড় করেছে। তবু মা-বাবার কদর তো আলাদা। তাই না?” কাদির অবশ্য সপরিবারে এখন তুরতুকেই। শুধু তাঁর দুই দাদা পরিবার থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছেন। “ওরা পড়তে ইসলামাবাদ গিয়েছিল। আর ফেরা হয়নি। বড়ভাই তো অনেকদিন হল মারা গিয়েছে। মেজভাই ইসলামাবাদে একটা মাদ্রাসা চালায়। সবাই গুলামভাই নামে চেনে। দু’বছর আগে একবার এখানে এসেছিল। ৪৫ বছর পর বাবাকে
জড়িয়ে সে কী কান্না!” অবধারিতভাবে কাদির ও জাহিদ-দুই বন্ধুর কাছেই গেল সেই প্রশ্ন। পাকিস্তান না ভারত? কার অধীনে তাঁরা খুশি? দু’জনেই প্রায় এক সুরে বললেন, “বেশিরভাগ সময় তো ভারতেই কাটালাম। খারাপ তো নেই? তবে দু’দেশের সরকারকে একটাই অনুরোধ তারা যদি কোনওভাবে এই সাধারণ পরিবারগুলোর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা করে দেয়!”
ফেরার পথে দেখলাম একে একে নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের নিয়ে উপরে উঠছে গাড়ি। তবে তার থেকেও মাথায় ঘুরছিল অন্য আরেকটা কথা। প্রান্তিক গ্রামগুলোয় এসে কোথায় যেন মিল পাই বনগাঁ, বসিরহাটের। ওখানেও তো প্রচুর পরিবারের আত্মীয় থাকে সীমানার ওপারে। তবে একটা বাঁচোয়া বৈধভাবে তারা যেতে পারে পূর্ববঙ্গে। কিন্তু, এঁরা যে আত্মীয়দের মাটিও দিতে পারেন না। তবু দেশভক্তিতে কোনও কসুর নেই তুরতুকের। স্বজনহারার কষ্ট ভুলে তাঁরা ‘নাগরিক কর্তব্য‘ পালন করে এসেছেন, করবেনও। শুধু একটাই আর্জি। ‘সরকার যদি একটু নরম হয়…।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.