সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: উসকো-খুসকো চুল। চোখেমুখে ক্লান্তি। এলোথেলো বেশ। কোনওমতে মোবাইল ফোনটাকে কানে আঁকড়ে রেখেছেন। দেখে বোঝাই যাচ্ছে, ফোনের ওপারের মানুষটির কাছ থেকে এমন কোনও দুঃসংবাদ পেয়েছেন যে কান্না আর চেপে রাখতে পারছেন না। একানাগাড়ে হাউ হাউ করে কেঁদে চলা এই মানুষটির ছবি গত দু’দিনে হয়তো অনেকের কাছেই পৌঁছেছে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে। ইনি রামপুকার পণ্ডিত। পরিযায়ী শ্রমিক। মৃত্যুপথযাত্রী ছেলের কথা শুনে মাঝ রাস্তাতেই কুঁকড়ে গিয়েছিলেন।
রামপুকার পণ্ডিতের বাড়ি বিহারের বেগুসরাইতে। বর্তমানে বাড়ি পৌঁছেছেন ঠিকই কিন্তু ওঁর ছেলে আর বেঁচে নেই। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকা ছেলেটি শেষবারের জন্য দেখতে পায়নি তার বাবাকে। মাইলের পর মাইল হেঁটে অসহায় বাবাও মৃত্যু শিয়রে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারলেন না। রামপুকারের মতো আরও কত শত অসহায় গল্পগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে করোনা মোকাবিলায় ‘স্ট্র্যাটেজি’র নিচে! তবে এই রামপুকার পণ্ডিতের বাড়ি পৌঁছনোটাও কিন্তু অত সহজে হয়ে ওঠেনি। তার আগের কাহিনিটাও হৃদয় বিদারক।
কান্নায় ভেঙে পড়া রামপুকারের এই ছবিটির নেপথ্যে যিনি, তিনি পিটিআই সংবাদ সংস্থার একজন আলোকচিত্রী, অতুল যাদব। লকডাউনের দিনগুলোয় একরকম হাজারো রামপুকার পণ্ডিতের অসহায়তা ধরা দিয়েছে তাঁর ক্যামেরার লেন্সে। তাই খানিক গা সওয়াই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গত সোমবার দিল্লির নিজামউদ্দিনের কাছে এই অসহায় মানুষটিকে ফোন আঁকড়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে দেখে এড়িয়ে যেতে পারেননি। তড়িঘড়ি গাড়ি থেকে নেমে অতুল এগিয়ে যান অসহায় মানুষটির দিকে।
কথাপ্রসঙ্গে কানের ফোন সরিয়ে অপরদিকের মানুষটি জড়ানো গলায় উত্তর দেন, “ওঁর ছেলে গুরুতর অসুস্থ। মৃত্যুপথযাত্রী। যে কোনও সময়ে দুঃসংবাদ আসতে পারে। কিন্তু উনি বাড়ি ফিরতে পারছেন না। তাই গত ৩ দিন ধরে নিজামউদ্দিনের কাছে সেতুর উপরই বসে রয়েছেন অসহায়ভাবে। পুলিশ অনুমতি দেয়নি ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে যাওয়ার।” বাড়ি কোথায়? জিজ্ঞেস করতেই অতুলকে তিনি উত্তর দিলেন- ‘উধার’ (ওদিকে)। সংবাদসংস্থার আলোকচিত্রীর এই ‘উধার’-এর মানে বুঝতেও কিছুটা বেগ পেতে হল। ‘উধার’ মানে, এই ব্যক্তির বাড়ি বিহারের বেগুসরাই। যেখানে বসে রয়েছেন সেখান থেকে ১২০০ কিলোমিটার দূরে। বিহার থেকে নফাজগড়ে এসেছিলেন শ্রমিকের কাজ করতে। লকডাউনে বাড়ি ফিরতে পারেননি। ছেলের অসুস্থতার খবর শুনে হাঁটতে শুরু করেছেন। কিন্তু যমুনা সেতুর কাছে এসে আর যেতে পারেননি। তিন দিন ধরে অভুক্ত অবস্থায় ওই একই জায়গায় বসে রয়েছেন।
অতুল ওঁকে জল-বিস্কুট এগিয়ে দিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে গেলেন। অনুনয়-বিনয় করে রামপুকারকে বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করতে বললেন। প্রথমটায় পুলিশ কানে না তুললেও পরে সংবাদমাধ্যমের লোক দেখে ইতিবাচক উত্তর এল। এতসবের মাঝে অতুলের তখনও জানাই হয়নি ওই ব্যক্তির নাম, ফোন নম্বর কিছুই! রামপুকারের ছবিও বেরলো। সেই সঙ্গে ছবির নেপথ্যের স্টোরিও জানল লোক। ভাইরাল হতে সময়ও নেয়নি ওই অসহায় বাবার আকুতি-মিনতির ছবি। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতেই উদ্ধার করা গেল পরে যে ওঁর নাম রামপুকার পণ্ডিত। উনি বাড়ি ফিরেছেন ঠিকই, কিন্তু দেরী হয়ে গিয়েছে। ছেলে আর বেঁচে নেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.