বিশ্বদীপ দে: কথায় বলে দিল্লি যেতে হলে লখনউ হয়েই যেতে হবে। এহেন গুরুত্বপূর্ণ উত্তরপ্রদেশের রাজধানী শহরকে বার বার নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সাক্ষী থাকতে হয়েছে। শুধু ওই শহর কেন, গোটা রাজ্য জুড়েই এক অস্থিরতা দেখা গিয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। যার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে দলিত, যাদব, বাহুবলীর মতো নানা শব্দ। আর সর্বোপরি থেকেছে একটি মোক্ষম শব্দবন্ধ- গুন্ডারাজ! এমন নয়, হিংসা কেবল উত্তরপ্রদেশেই (Uttar Pradesh) সীমাবদ্ধ। কিন্তু তবুও বহু বছর ধরেই অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠার বদনাম বইতে হয়েছে এই রাজ্যটিকে। যোগী আদিত্যনাথের আমলে অপরাধের তীব্রতা কমার দাবি করা হলেও গত বছর যখন পুলিশ ও সংবাদমাধ্যমের সামনেই ১২টি বুলেটে ঝাঁজরা হতে হল আতিক আহমেদকে, তখন বোঝা গেল ভিতরে ভিতরে একই রকম বয়ে চলেছে অপরাধের স্রোত। কিন্তু এর শুরু কোথায়?
গত কয়েক বছর এদেশের ওটিটি মঞ্চে অন্যতম সফল সিরিজ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ‘মির্জাপুর’। খুনোখুনি, হিংসা, বদলার এই কাহিনি এবার তৃতীয় সিজনে এসে পৌঁছেছে। এই মির্জাপুর যেন উত্তরপ্রদেশে বাহুবলীদের দ্বন্দ্বের গল্পকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সেই কবে ‘রাজর্ষি’তে রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘এত রক্ত কেন?’ সেই প্রশ্নই অনুরণিত হতে থাকে সিরিজ জুড়ে। বলতে গেলে সিরিজ ছাপিয়ে তা সামগ্রিক ভাবেই একটা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে কয়েক দশক ধরে ঝুলে রয়েছে মধ্যভারতের এই রাজ্যের আকাশে। কেন এত হিংসা? কেন রক্তস্রোত? আড়ালে রয়েছে কোন ইতিহাস?
একটা ধারণা রয়েছে, সমাজবাদী পার্টির আমলেই নাকি গুন্ডারাজ ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। সাম্প্রদায়িক হিংসা থেকে আইনবিহীন একেবারে অস্থির একটা সময়ের কথা তুলে ধরেন অনেকেই। কিন্তু সেই সময় যতই ভয়ংকর হোক, এর মূল কিন্তু রয়েছে আরও অতীতে। মোটামুটি গত শতকের আটের দশকের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেই সময় থেকেই একটা পরিবর্তন হচ্ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে। সেটা কংগ্রেস আমল। ১৯৯১ সালের মুলায়ন সিং যাদবের আগে টানা একযুগ কংগ্রেসই ছিল ক্ষমতায়। মনে রাখতে হবে রিগিং ব্যাপারটা তার আগের দশক থেকেই এদেশের ভোট সংস্কৃতির এক কলঙ্ক হিসেবে জন্ম নিচ্ছিল। গায়ের জোরে ভোট করানো কিংবা রিগিং করে জেতার মতো নানা অভিযোগ সেই সময়ের উত্তরপ্রদেশকে ঘিরে পাক খাচ্ছিল। আর এর পিছনে ছিল নেতাদের বিশ্বস্ত বাহুবলীরা। কিন্তু আটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই এই সব সমাজবিরোধীরা বুঝতে পারছিল, খামোখা অন্য নেতার হয়ে জীবন বিপন্ন না করে নিজেই ক্ষমতা দখল করলে ব্যাপারটা আরও সরেস হয়! সেই সময় থেকেই অপরাধ জগতের মানুষদের ভোটে দাঁড়ানো শুরু। ফলে পেশি ও টাকার জোর তখন থেকেই এক সম্মিলিত শক্তি হয়ে উঠতে থাকে।
আর এই সব প্রতিনিধিদের অপরাধমূলক চরিত্র তাঁদের বেশ কিছু তুলনামূলক সুবিধা দিতে থাকে। ভোটপ্রচার চালানোর জন্য অবৈধ উপায়ে মানুষকে একত্রিত করার ক্ষমতা, লোকবল, ভোটারদের একটা অংশকে ভয় দেখিয়ে দাবিয়ে রাখা… এই ধরনের প্রার্থীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ফলে রাজনীতি ও অপরাধের একটা এমন ধূসর মিশেল তৈরি হয়, যা তৈরি করে গুন্ডারাজ।
সাধারণ অঙ্ক বলে, বিজেপি উচ্চবর্ণ তথা ব্রাহ্মণদের উপরে বেশি ভরসা করে। আবার সমাজবাদী পার্টি যাদবদের পাশাপাশি মুসলিম ও অন্য ওবিসিদের প্রার্থী করতে চায়। এখন গুরুত্ব হারিয়ে ফেললেও বিএসপি একদা অনগ্রসর শ্রেণি, উচ্চবর্ণ ও মুসলিমদের উপরই বেশি ভরসা করে ক্ষমতাবৃদ্ধি করেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সমীকরণ বদলালেও একটা ব্যাপার দেখা যায়, সব দলের প্রার্থীদেরই অর্থনৈতিক ‘প্রোফাইল’ বেশ কাছাকাছিই। একটা সময়ে উত্তরপ্রদেশে আইনজীবী, চিকিৎসক কিংবা ইঞ্জিনিয়াররা প্রার্থী হতেন। এবং তাঁরা বেশির ভাগেই উচ্চবর্ণ। যদিও গ্রামে তাঁদের বেশ জমিজিরেত থাকত। এবং তাঁরা নিজেদের কৃষক বলে দাবি করতেন। এরকম আরও ভাগ ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, এঁদের সরিয়ে সেই জায়গা নিতে শুরু করেছেন অন্য আর্থ-পেশাদার জগতের মানুষেরা। নির্মাণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত বা কোল্ড স্টোরেজ, পরিবহণ সংস্থার মালিক। এইসব সফল ব্যবসায়ীদের প্রায় সকলেরই ছিল ক্রিমিনাল রেকর্ড। ফলে উত্তরপ্রদেশে ব্যবসাবাণিজ্যেও তার ছাপ পড়েছিল। আবার এমন মানুষও রাজনীতিতে আসছিলেন যাঁদের পরিবার বা তিনি নিজেও অপরাধজগতের সঙ্গেই যুক্ত। এই বিষয়টা খেয়াল করলেই বোঝা যায়, ক্ষমতা কাঠামোর এই পরিবর্তন চুপিসারে রাজনৈতিক পরিবেশটাকে আরও বিষিয়ে তুলছিল।
কিন্তু ২০১৭ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসে যোগী আদিত্যনাথের সরকার। আর এর পর থেকেই একটা প্রচার চলতে থাকে উত্তরপ্রদেশের সেই অন্ধকার দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। কিন্তু পরিসংখ্যান বুঝিয়ে দেয়, বাহ্যিক কিছু পরিবর্তন হলেও সবই ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’ হয়ে আছে। একটা পরিসংখ্যান বলছে ২০২০ সালে যেখানে মহিলাদের উপরে হওয়া নির্যাতনের ঘটনার সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার ছুঁই ছুঁই। যা ২০২১ সালে হাজার ছয়েক বেড়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৬৫ হাজারেরও বেশি ঘটনায়! শুকনো পরিসংখ্যান যদি সরিয়েও রাখা যায়, দেখা যাবে হাথরাস বা উন্নাওয়ের মতো ঘটনায় গোটা দেশ শিউরে উঠেছে।
গত বছর পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যে আতিক-আশরফকে হত্যার পর উত্তরপ্রদেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নতুন করে। দুই মৃত গ্যাংস্টারের আইনজীবীর বিস্ফোরক দাবি, তাঁর মক্কেলদের যখন প্রয়াগরাজ থেকে বরেলিতে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই সময় পুলিশ লাইনে নিয়ে গিয়ে এক পুলিশকর্তা আশরফকে হুমকি দেন, ”এ যাত্রায় বেঁচে গেলি, কিন্তু জেল থেকে বেরোনোর ১৫ দিনের মধ্যে খতম করে দেব।” এই একটি সংলাপের ঝলকই যেন বুঝিয়ে দেয়, ভিতরে ভিতরে রং বদলালেও উত্তরপ্রদেশ আছে উত্তরপ্রদেশেই। বিরোধীদের মুখেও উঠে আসতে থাকে একটা পুরনো শব্দবন্ধ- গুন্ডারাজ। যা বুঝিয়ে দেয় দেশের অন্য বহু রাজ্যে হিংসার ছবিটা যেমন মিথ্যে নয়, তেমনই উত্তরপ্রদেশেও শিকড়ের সঙ্গে মিশে গিয়েছে অপরাধমনস্কতা। যা থেকে মুক্তি পাওয়া কার্যতই অসম্ভব! অন্তত প্রবল কঠিন তো বটেই। বিষ যে বহুদূর চারিয়ে গিয়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.