সুচিন্তা পালচৌধুরী: দুলন দাস। এক সময় তিনি ছিলেন বাংলাদেশের নাগরিক। কিন্তু গত মঙ্গলবার থেকে তিনি খাতায়-কলমে ভারতীয়। অসমের বাসিন্দা। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে (সিএএ) ভারতের নাগরিকত্ব পেয়েছেন এই বাংলাদেশি হিন্দু। আর এখানেই ‘বিন্দুতে সিন্ধু’ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতিহাস পাড়ি দিচ্ছে গত শতকের আটের দশকে হওয়া ‘অসম চুক্তি’র সময়কালে। দুলনের নাগরিকত্ব প্রাপ্তি যেন সেই চুক্তিকেই অসাড় করে তুলছে। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি এবার অসমে অনেক বাংলাদেশিকেই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে? শুরু হয়েছে প্রতিবাদ।
সেই অসম। যেখানে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে মৃত্যু হয়েছিল ৫ জনের। দুলনের নাগরিকত্ব পাওয়ায় নতুন করে ক্ষোভে ফুঁসছেন অসমের ভূমিপুত্ররা। কারণ দুলন ১৯৮৮ সাল থেকে শিলচরে বসবাস করেছেন। তাঁর নাগরিকত্ব প্রাপ্তিতে কি মুছে যাচ্ছে না অসমিয়াদের রক্তক্ষরণের দগদগে ইতিহাস? অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, আজ দুলন পেয়েছেন। কাল হয়তো আরও দশজন সিএএতে নাগরিকত্ব পাবেন। ফলে উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যে ভিড় বাড়বে বাংলাদেশি বা অন্যান্য বিদেশিদের।
এহেন পরিস্থিতিতে ফিরে দেখা দরকার‘অসম চুক্তি’-র ইতিহাস। আটের দশকের অগ্নিগর্ভ অসমকে ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধী শান্ত করেছিলেন প্রফুল্ল মহন্ত, ভৃগু ফুকনদের সঙ্গে ‘অসম চুক্তি’ স্বাক্ষর করিয়ে। সেই অসম চুক্তিতেই ব্রহ্মপুত্র-ভূমের ‘বিদেশি’ অনুপ্রবেশের সমস্যাটি সমাধানের জন্য জাতীয় নাগরিকপঞ্জির সংশোধনের কথা বলা হয়েছিল ১৯৭১ সালে ২৪ মার্চকে ভিত্তি ধরে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে যাঁরা অসমে বসবাস করছেন, তারা ‘ভারতীয় নাগরিক’ হিসাবে বিবেচিত হবেন। তার পর যাঁরা সেখানে বাংলাদেশ থেকে এসে বসবাস করছেন তাঁরা নাগরিকত্ব পাবেন না। ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর চুক্তির পর ব্রহ্মপুত্র দিয়ে অনেক জল বয়ে গেলেও নাগরিকপঞ্জির জটটা দূর হয়নি।
২০১৬-তে অসমে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নাগরিকপঞ্জি নিয়ে ভূরি ভূরি অভিযোগ উঠতে থাকে। সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে এই নাগরিকপঞ্জি তৈরির কাজ হলেও অভিযোগ ওঠে এই কাজে রাজ্য সরকারের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপকে ঘিরে। প্রশ্ন ওঠে, কেন্দ্র কেন ২০১৬ সালে দেশের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন করে অ-মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের নাগরিকত্ব দিতে সম্মত হল? প্রশ্ন ওঠে, নাগরিকপঞ্জিতে নাম তোলার আবেদন জানিয়ে যে ৪৭ লক্ষ অসম-নিবাসী পঞ্চায়েত প্রধানের দেওয়া শংসাপত্র জমা করেছিল, তা কেন রাতারাতি বাতিল করে দেওয়া হল। সেই থেকেই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে ক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকে অসমে।
চলতি বছরের জুলাই মাসে নাগরিকত্ব আইন কার্যকর হয় দেশে। আবেদন করেন অসমের বেশ কয়েকজন। যার মধ্যে আদতে ওপার বাংলার সিলেটের বাসিন্দা দুলন অন্যতম। তিনি তো নাগরিকত্ব পেলেন। কিন্তু ‘অসম চুক্তি’-র কী হল? সেখানে তো পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর অসমে আর কেউ ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন না। আর দুলন তো এসেছেন ১৯৮৮ সালে। এখানেই প্রশ্ন, তাহলে কি লঙ্ঘিত হল না ‘অসম চুক্তি’? যার জন্য মাটি কামড়ে লড়াই করেছিলেন অসমিয়ারা। ঝরিয়ে ছিলেন রক্ত। তাঁদের সেই অবদানকে কী খাটো করা হচ্ছে না? সাম্প্রতিক সময়ে অসম, মণিপুরের মতো রাজ্য়গুলোতে অনুপ্রবেশ বেড়েছে। মাথাচাড়া দিয়েছে নানা সন্ত্রাসী সংগঠন। এই অনুপ্রবেশ রুখতেই একদিন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অসমের ভূমিপুত্ররা। একদিন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাই বড় মুখ করে বলেছিলেন সিএএ তিনি মানবেন না। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তিনিই সেটাকে কার্যকর করছেন। যার ফলে তাঁকে ‘প্রতারক’ বলে বিঁধছেন দিয়েছেন প্রতিবাদীরা।
অসমের বাঙালিরা বরাবর শান্তিপ্রিয়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় কিংবা বরাক উপত্যকায় যে লক্ষ লক্ষ বাংলাভাষী থাকেন, তাঁরা শান্তিতে থাকেন। জীবনযুদ্ধে নিয়োজিত থাকেন। তবে অতীতে অসমের বেশ কয়েকটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপ দেখা গিয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদ অসমের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রচুর রক্তক্ষরণ করেছে। এবারও কি সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে? কী বলছেন অসমের মানুষ। প্রতিক্রিয়া জানার জন্য তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালের তরফে।
এই বিষয়ে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত হীরেন গোঁহাইয়ের সঙ্গে। যিনি অসমের বিখ্যাত সাহিত্যিক ও একাধারে সাহিত্য সমালোচক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক। তাঁর কথায় “এটা খুবই অদ্ভুত নয় কি যে দিল্লি হোক বা দিসপুর কেউ প্রকাশ্যে বলছে না যে অসম চুক্তি কার্যত বাতিলের খাতায়। এমনকী সুপ্রিম কোর্টও মৌন। যেন সকলেই চায় অসমবাসী এই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির দগদগে ইতিহাস ভুলে যাক। এতে সরকারের গুরুত্ব কি মানুষের কাছে কমে যাচ্ছে না? আপনাদের হাতে ক্ষমতা রয়েছে বলে যা ইচ্ছে তাই করবেন? এই সরকার কোনও সীমা, কোনও সাংবিধানিক লক্ষণরেখা মানে না।” দুলন দাসকে নিয়ে তাঁর সাফ প্রশ্ন, “তিনি যদি এতদিন এখানকার নাগরিক না হন তাহলে ১৯৮৮ সাল থেকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন কী করে? এটাই তো প্রমাণ যে অসমে কত লক্ষ লক্ষ অবৈধ শরণার্থী রয়েছেন।” উল্লেখ্য, নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে অসমীয়া ভাষী এবং হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি হতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন। এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “পরস্পরের যুক্তিকে সম্মান করলে এমনটা হওয়ার কথা নয়। এটা একে অপরকে দোষারোপ করার সময় নয়।” অসমের ভূমিপুত্র কারা? উত্তরে হীরেন গোঁহাই জানালেন, “১৯ শতকের শেষে যাঁদের পূর্বপুরুষরা এখানে এসেছিলেন। এরাজ্যের ভাষা, সংস্কৃতিকে আপন করে বসবাস শুরু করেছিলেন তাঁরাই এখানকার ভূমিপুত্র।”
শুরুর দিকে শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানের একটা পথ হিসাবে সিএএ গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করেছিলেন ‘সারা অসম বাঙালি যুবছাত্র ফেডারেশন’-এর সভাপতি দীপক দে। দেশভাগের বলি যে হিন্দু বাঙালিরা তাঁদের আশ্রয়ের জন্য সিএএ-এর প্রয়োজনীয়তা জয়েন্ট পার্লামেন্ট কমিটিতেও তুলে ধরেছিলেন। দাবি ছিল, এই মানুষদের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মাধ্যমে নিঃশর্ত নাগরিকত্ব প্রদান করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে যখন সিএএ কার্যকর হয় তখন দেখা যায় কেন্দ্র থেকে একগুচ্ছ নথি চাওয়া হয়েছে। যেগুলো হয়তো অনেকেই দেখাতে পারবেন না। ফলে এর মাধ্যমে দুলন দাসের মতো একজন হয়তো লাভবান হয়েছেন। বাকিরা যেখানে রয়েছেন সেখানেই থাকবেন। এমনই হতাশা ধরা পড়ল দীপক দের গলায়। আর অসম চুক্তি? ক্ষোভ প্রকাশ করেই তিনি বললেন, “কয়েকটা জাতীয়তাবাদী সংগঠন এটা নিয়ে দ্বিচারিতা করছে। ১৯৭১-এর আগে থেকে যাঁরা এখানে রয়েছেন তাঁদের অনেকেই আজও ডি-ভোটার। এই হিন্দু বাঙালিরা তো আজও স্বীকৃতি পেলেন না। তাঁদের জন্য তো আজও কেউ গলা তুলল না।” ফলে সিএএ যে ডিটেনশন ক্যাম্প থাকা বহু হিন্দু বাঙালির কোনও সুরাহা করতে পারবে না তা বিস্তর বুঝে গিয়েছেন তিনি। এই নয়া আইন কার্যকর হওয়ার পর নানা প্রতিবাদ দেখেছে অসম। আগামিদিনে এর আগুন কতদূর ছড়াতে পারে? দীপকবাবুর কথায়, “শুরুর দিকে পুরোটাই নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে রাজনৈতিক চাল ছিল। ভুল ধারণার বশবর্তী হয়েছিলেন মানুষ। কিন্তু এখন তাঁদের ভুল ভেঙেছে। সকলে বুঝতে পেরেছেন সিএএ-র দ্বারা খুব একটা কিছু হবে না।” তবে ভবিষ্যতের কথা ভেবে অসমবাসী যে নানা কারণে শঙ্কিত তা অস্বীকার করেননি দীপকবাবু।
সিএএ নিয়ে কথা হচ্ছিল অসমের গোলাঘাট জেলার চা ব্যবসায়ী গৌতম দেবের সঙ্গে। উনি কিন্তু অসমের ভূমিপুত্র। স্বাধীনতার আগে থেকে তাঁর পরিবারের বাস এরাজ্যে। যাঁরা দেখেছেন ‘বাঙাল খেদাও’ আন্দোলন। বাঙালি হওয়ার কারণে একসময় অসমিয়াদের থেকে নানা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন তাঁরা। ওপার বাংলা থেকে বাঙালি হিন্দুরা এদেশে এসে ভিড় করায় নানা কথা এখনও শুনতে হয়। এই ক্ষোভ নিয়েই তাঁর প্রশ্ন, “দুলন দাসের ঘটনায় তো অসম চুক্তির কোনও অস্তিত্বই থাকছে না। এখন কেন সবাই বাংলাদেশ থেকে এখানে আসছেন? এতদিন কিসের অপেক্ষায় ছিলেন তাঁরা?” গণ আন্দোলনের জেরে বাংলাদেশে যে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল সেই কারণে বহু মানুষ সীমান্তে এসে ভিড় করেছিলেন। চাইছিলেন ভারতের আশ্রয়। তাঁদের গলায় শোনা গিয়েছিল জয় শ্রী রাম ধ্বনিও। গৌতমবাবুর বক্তব্য, “তাঁরা কী ভেবেছিলেন জয় শ্রী রাম বললেই কেন্দ্র ভারতের নাগরিকত্ব দিয়ে দেবে?” আজ দুলন দাস। কাল তাঁর মতো হয়তো নাগরিকত্ব পাবেন আরও বেশ কয়েকজন। চাপ বাড়বে সব ক্ষেত্রেই। তখন ফের আশির দশকের অগ্নিগর্ভ অসম দেখবেন ভারতবাসী? গৌতমবাবুর কথায়, “এখন সেভাবে আর সিএএ নিয়ে প্রচার নেই। কয়েকটা জায়গায় প্রতিবাদ হচ্ছে ঠিকই। তবে এখনই সেই বড় আন্দলোন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এই দুলন দাস আজ একজন। কালকে এই সংখ্যাটা হবে দেড়শো। তার পর হাজার। তখন কিন্তু ভূমিপুত্ররা, অসমের অন্যান্য বাসিন্দারা বড় ধরনের প্রতিবাদে শামিল হতেই পারেন।”
দুলন দাসের নাগরিকত্ব পাওয়া নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছে অসমের গুয়াহাটিতে। যা নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম সেখানকার তরুণ নগরের স্থানীয় বাসিন্দা তথা সাংবাদিক পল্লব বোরার সঙ্গে। অসমে শুধু হিন্দু নয়,বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের মতো নানা ধর্মের শরণার্থী রয়েছেন। যাঁরা অপেক্ষা করছেন ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার। এভাবেই নানা সম্প্রদায়, নানা ধর্মের মানুষের সংখ্যা বাড়বে। প্রভাব পড়বে অসমের সংস্কৃতিতে। যা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে অসমের মানুষের মনে। পল্লববাবু জানালেন, “অসমে যদি এই নাগরিকত্ব দেওয়ার মাধ্যমে জনসংখ্যা বাড়ে তাহলে তা সত্যির চিন্তার বিষয়। কারণ তখন চাপ বাড়বে কাজের জায়গাগুলোতেও। কর্ম সংস্থান একটা বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। সেই কারণেই এখানে প্রতিবাদ হচ্ছে।” তবে এই প্রতিবাদ-আন্দোলন এখন যে খুব একটা বড় আকার নেবে না স্পষ্ট করেছেন তিনি। পল্লববাবুর কথায়, “আগের বার অসম আন্দোলন করেছিল আসু (অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন)। কিন্তু এবারে তাদের তেমন তৎপরতা চোখে পড়ছে না। ফলে বড় মাপের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নেতৃত্বের অভাব রয়েছে এবারে।” সকলের যা প্রতিক্রিয়া তাতে বোঝা গেল, গোটা অসমের দিক থেকে দেখতে গেলে এখন পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত। এই সিএএ নিয়ে প্রতিক্রিয়া হয়তো মানুষ দেবেন ভোটবাক্সে। এখন হয়তো প্রতিবাদ-আন্দোলন অনেকটাই থিতিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ক্ষোভ রয়েছে মানুষের মনে। ঘুরে ফিরে আসছে সেই একটাই প্রশ্ন। দুলন দাস আজ একজন। আগামিতে এই সংখ্যাটা লাফিয়ে বাড়লে তখন কী করবেন ভূমিপুত্ররা? কারণ সিএএ-এ আসায় অসম চুক্তির আর কোনও গুরুত্ব রইল না। বিশ্লেষকদের মতে, মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার অপর ক্ষুন্ন অসমের মানুষ। এর মূল্য হয়তো বিজেপিকে চোকাতে হতে পারে ভোটের ময়দানে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.