Advertisement
Advertisement

Breaking News

Kashmiri Pandit

তিন দশক ধরে শুধুই রাজনীতির শিকার কাশ্মীরি পণ্ডিতরা! কেন ফেরা হল না ঘরে?

কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দুর্দশার দায় কি কেবল কংগ্রেসেরই?

The bloody saga of Kashmiri Pandits। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:March 18, 2022 5:36 pm
  • Updated:March 19, 2022 12:06 pm  

বিশ্বদীপ দে: একটা দৃশ্য দিয়ে শুরু করা যাক। তরুণ কাশ্মীরি পণ্ডিত সতীশ টিকু একদিন রাতে শুনতে পেলেন তাঁর বাড়ির বাইরে কয়েকজন এসে তাঁরই নাম ধরে ডাকাডাকি করছে। বেরিয়ে আসতেই একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ছিটকে এল গুলি। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। সংজ্ঞা হারানোর আগে নিশ্চয়ই তাঁর মাথার মধ্যে কাজ করছিল একটা বিস্ময়। কারণ আততায়ীর দলে ছিল একটি ছেলে, যে তার প্রতিবেশী। বেশ কয়েকবার তাকে নিজের স্কুটারে লিফটও দিয়েছেন তিনি! সেই ছেলেটিই একদিন এভাবে স্বয়ং মৃত্যু সেজে এসে দাঁড়াবে দরজার বাইরে, একথা কি কোনওদিনও কল্পনা করতে পেরেছিলেন সতীশ?

দেখতে দেখতে তিরিশ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। আজও ইতিহাসের পাতায় এক গভীর জলছাপ হয়ে রয়ে গিয়েছে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের (Kashmiri Pandit) উপরে হওয়া নির্যাতনের দগদগে এই ক্ষতচিহ্ন। কোনও বৃহৎ ট্র্যাজেডিকে বুঝতে হলে বোধহয় এই ধরনের টুকরো টুকরো দু-একটা ঘটনাই অনেক কথা বলে দিতে পারে। আসলে দাঙ্গা হোক কিংবা কোনও ধরনের গণহত্যা, সাধারণ মানুষের এই অসহায়তাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি মর্মস্পর্শী। রাহুল পণ্ডিতিয়ার ‘আওয়ার মুন হ্যাজ ব্লাড ক্লটস’ নামের স্মৃতিকথায় রয়েছে সতীশ টিকুর মতো অসংখ্য হতভাগ্য মানুষের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার বিবরণ। যা বুঝিয়ে দেয়, সেই হননকালে কীভাবে বিপন্ন হয়েছিলেন কাশ্মীরি পণ্ডিতরা।

Advertisement
Kashmiri-Pandit-inside
‘শিকারা’ ছবিতেও উঠে এসেছিল কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জীবন সংগ্রাম

[আরও পড়ুন: রাশিয়ার হয়ে লড়তে ইউক্রেনের উদ্দেশে পাড়ি দিল ১ হাজার দুর্ধর্ষ চেচেন যোদ্ধা]

সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’। ছবিটিকে ঘিরে তৈরি হওয়া নানা তর্ক-বিতর্কের স্পর্শে ফের ফিরে আসতে শুরু করেছে তিরিশ বছর আগের দুঃস্মৃতি। একেবারে এই প্রজন্মের যাঁরা, তাঁরাও জানতে চাইছিলেন ঠিক কী হয়েছিল সেই সময়? কেন নিজেদের এতদিনের ভিটেমাটি ছেড়ে রাতারাতি শরণার্থীর জীবন বেছে নিতে হয়েছিল কাশ্মীরি পণ্ডিতদের?

১৯৯০ সালের ১৯ জানুয়ারি থেকে যে ভয়ংকর সময়ের সূচনা, তার ভিত্তিরপ্রস্তর বোধহয় স্থাপিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে। সেই বছরই জম্মু ও কাশ্মীরের (Jammu and Kashmir) মুখ্যমন্ত্রী হন ফারুক আবদুল্লা। ১৯৮৩ সালে ফারুকের দল ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স’ ইন্দিরা গান্ধীর (Indira Gandhi) কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়াই করে। ১৯৮৪ সা‌লের লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরার সঙ্গে ফারুকের তিক্ততা আরও বাড়ে। কারণ সেই সময় বিক্ষুব্ধ নেতা গুলাম মহম্মদ শাহ, যিনি ফারুকের জামাইবাবু তিনি ন্যাশনাল কনফারেন্সের ১৩ জন ও কংগ্রেসের ২৬ জন বিধায়ককে নিয়ে ফারুককে মসনদ থেকে সরিয়ে দেন। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ নেতৃত্বের এই পরিবর্তনের বিরোধিতা করেন। শুরু হয় ধরনা প্রদর্শন।

kashmiri-Pandit
ছবি সৌজন্য: এএফপি

কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপরে প্রথম হিংসার ঘটনা ঘটে ১৯৮৬ সাল‌ে। সেই বছরই রাজীব গান্ধী সরকার বাবরি মসজিদের দরজা হিন্দুদের জন্য খুলে দেয়, যার জের পৌঁছয় কাশ্মীরেও। অনন্তনাগে বহু কাশ্মীরি পণ্ডিত ও হিন্দু মন্দিরে হামলা করা হয়। সেই সময় নানা উসকানিমূলক পোস্টারও দেখা যেতে শুরু করে মন্দির-মসজিদে।

[আরও পড়ুন: ‘মাছির মতো ছুঁড়ে ফেলে দেব’, দেশের মধ্যেই প্রতিবাদে দিশেহারা পুতিনের হুঙ্কার]

পরিস্থিতি এমনদিকে গড়ায়, ১৯৮৬ সালে গুলাম মহম্মদ শাহের সরকারকে বরখাস্ত করে প্রথমবারের জন্য কাশ্মীরে শুরু হয় রাষ্ট্রপতি শাসন। ১৯৮৭ সালে সালের বিধানসভা নির্বাচনে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয়। সেবার কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলায় ফারুকের দল। সেই জোটের বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট। নির্বাচনে তারা পায় মাত্র ৪টি আসন। যেখানে কংগ্রেস ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের জোট পেয়েছিল ৬৬টি আসন। অভিযোগ ওঠে সেবার নাকি বিস্তর রিগিং হয়েছিল। মহম্মদ ইউসুফ নামের এক প্রার্থী সেই ভোটে জিততে জিততেও নাকি হেরে গিয়েছিল। শুরু হয় অশান্তি। ইউসুফের জেল হয়। পরবর্তী সময়ে এই ইউসুফই হয়ে ওঠে হিজবুল মুজাহিদিনের প্রধান জঙ্গি নেতা।

১৯৮৮ সাল থেকেই কাশ্মীর জুড়ে শুরু হয় আতঙ্কবাদের নগ্ন নৃত্য। সিনেমা হল, বিউটি পার্লার, পানশালা, ভিডিও লাইব্রেরির মতো জায়গাকে টার্গেট করা হচ্ছিল। জোরাল হচ্ছিল জেকেএলএফের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর ‘কাশ্মীর ছোড়ো’ স্লোগান। আর বিপণ্ণ হচ্ছিল কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জীবন। অশোক কুমার পাণ্ডের লেখা একটি বইয়ে রয়েছে, প্রত্যক্ষদর্শী রামকৃষ্ণ কলের বয়ান। তাঁর দাবি ছিল, সেই সময় কাশ্মীর থেকে সরাসরি রাওয়ালপিণ্ডি যাওয়ার বাস মিলত! সেই বাসে করে তরুণ কাশ্মীরিরা পাকিস্তানে গিয়ে তালিম নিত জঙ্গি হওয়ার। মসজিদ, রাস্তা, অলিগলি সর্বত্র আওয়াজ উঠতে শুরু করে ‘রালিব, গালিব, চালিব’। অর্থাৎ হয় আমাদের সঙ্গে হাত মেলাও নয়তো মরো কিংবা পালিয়ে যাও।

শুরু হয়ে যায় নিধন যজ্ঞ। কিন্তু ১৯৯০ সাল পড়তে না পড়তেই পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। উর্দু সংবাদপত্র ‘আফতাবে’ হিজবুল মুজাহিদিন হুমকি দেয় কাশ্মীরি পণ্ডিতরা এই এলাকা ছেড়ে চলে যান। নয়তো ফল খারাপ হবে। ১৯ জানুয়ারির রাত থেকে আর কোনও আড়াল আবডাল বলে কিছু রইল না। শুরু হয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নৃশংস অত্যাচার। পরবর্তী তিন মাস জুড়ে খুন, বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া ও ধর্ষণের মতো ঘটনা মুর্হুমুর্হু ঘটতে থাকে। সেই সময় কাশ্মীরের রাজ্যপাল ছিলেন জগমোহন। তিনি পরিস্থিতি বিচার করে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বলেন নিজেদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। মাস তিনেকের মধ্যেই তাঁদের ডেকে নেওয়া হবে। কিন্তু আর ফেরা হল কই? নিজেদের এতদিনের আবাস, শিকড় ছেড়ে রাতারাতি ঠাঁইনাড়া হয়ে যেতে হল অসংখ্য মানুষকে। যাঁদের ক্ষমতা ছিল, তাঁদের কেউ কেউ বিদেশে চলে গেলেন। কেউ কেউ দিল্লি বা অন্য শহরে মোটামুটি বন্দোবস্ত করেও ফেললেন। কিন্তু বড় অংশকেই আশ্রয় নিতে হল শরণার্থী শিবিরগুলিতেও। কতটা কঠিন ছিল সেই জীবন? এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের দাবি, জম্মু কাশ্মীরের পুনর্বাসন কমিটির একটি রিপোর্টে রয়েছে, মেয়েরা এমনই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল যে অনেকেরই ৪০ বছরের আগেই মেনোপজ হয়ে গিয়েছিল। কারও কারও ক্ষেত্রে তা ৩৪ বছরেই হয়ে গিয়েছিল।

জীবন গিয়েছে চলে। আজও ঘরে ফেরার টান রক্তের মধ্যে নিয়ে অপেক্ষা করে চলেছেন কাশ্মীরি পণ্ডিতরা। কবে ফিরবেন তাঁরা? উত্তর মেলে নাই। কেবল ঝনঝনিয়ে বেজে উঠেছে রাজনৈতিক বিতণ্ডার কর্কশ ধ্বনি। বিজেপি কাঠগড়ায় তুলতে চেয়েছে কংগ্রেসকে। আবার পালটা অভিযোগও উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, সেই সময় ভিপি সিং সরকারে ছিল বিজেপির ৮৫ জন সাংসদ। তাঁরা তো সরকার ফেলার চেষ্টা করেননি। মোদি সরকারের প্রায় ৮ বছরের আমলেও পুনর্বাসন পাননি কাশ্মীরি পণ্ডিতরা। ২০১৯ সালে সংবিধানের ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়া হয়েছিল। তারপরও কেন হল না ঘরছাড়া মানুষদের ঘরে ফেরা?

Veteran leader Jitan Ram Manjhi alleges The Kashmir Files makers have terror links

শেষ করা যাক সম্প্রতি পরেশ রাওয়ালের একটি টুইটের তলায় জনৈক শিবানী ধর সেনের মন্তব্য দিয়ে। নিজেকে কাশ্মীরি পণ্ডিত বলে দাবি করা ওই মহিলা স্পষ্টতই জানিয়েছেন, তিনি কাশ্মীরি পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ দেখবেন না। তাঁর আরজি, ”ঘৃণা ছড়াতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ইতিহাসকে ব্যবহার করা বন্ধ হোক।” বহু দিন ধরেই এই আরজি জানিয়ে চলেছেন কাশ্মীরি পণ্ডিতরা। কিন্তু সেকথা কেউ শুনলে তো?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement