Advertisement
Advertisement
Manekshaw

৯ গুলি খেয়েও রসিকতা! মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে ধরাশায়ী করেছিলেন ‘স্যাম বাহাদুর’ই

ইন্দিরার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছিলেন কিংবদন্তি সেনানায়ক।

Strange story of Sam Manekshaw। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:December 9, 2023 8:24 pm
  • Updated:December 9, 2023 8:31 pm  

বিশ্বদীপ দে: ফিল্ড মার্শাল স্যাম হরমুসজি ফ্রামজি জামশেদজি মানেকশ। ভারতীয় সেনার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা এক নাম। যে নাম নতুন করে ফিরে এসেছে ভিকি কৌশলের সিনেমার হাত ধরে। কিন্তু তার আগেও মানেকশ কখনওই বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাননি। চার দশক ধরে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সময়কালে একেবারে ফ্রন্টলাইনেই ছিলেন তিনি। এমন এক কিংবদন্তি মানুষকে কি কেউ কখনও ভুলতে পারে? তবে তাঁর অতুলনীয় কীর্তির সবটা হয়তো সকলের জানা নেই।

মানেকশ (Sam Manekshaw) মানেই অকুতোভয় এক মানুষ। শত্রুর গুলি থেকে ইন্দিরা গান্ধীর মতো দাপুটে প্রধানমন্ত্রী, মেরুদণ্ড বরাবর ঋজু রেখেই চলেছেন তিনি। এ এক আশ্চর্য জীবন! অমৃতসরের এক পার্সি পরিবারে মানেকশর জন্ম ১৯১৪ সালের এপ্রিলে। আর জুলাই মাস থেকেই শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ! কী সমাপতন! যুদ্ধের বিক্রমের সঙ্গে যাঁর নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে, তাঁর জীবন এভাবে শুরু থেকেই ছুঁয়ে রয়েছে মহাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে।

Advertisement
Manekshaw
মেরুদণ্ড বরাবর ঋজু

[আরও পড়ুন: উদ্বোধনের বাকি দেড় মাস, প্রকাশ্যে অযোধ্যার রাম মন্দিরের গর্ভগৃহের ছবি]

পদ কিংবা যশ নয়, দেশের সুরক্ষাই ছিল স্যামের জীবনের বীজমন্ত্র। অথচ এমন এক মানুষ হয়তো হয়ে যেতেন পাকিস্তানের নাগরিক! বাবা হরমুশজি মানেকশ ভেবেই ছিলেন লাহোরে চলে যাবেন। কিন্তু গুজরাট থেকে সেখানে যাওয়ার সময়ই প্রসব বেদনা শুরু হয় তাঁর স্ত্রীর। অগত্যা অমৃতসরেই নেমে পড়তে হয় ট্রেন থেকে। সেখানেই জন্ম হয় স্যামের দাদার। ব্যাস। আর অন্যত্র থিতু হওয়া সম্ভব হয়নি হরমুশজির। মানেকশ থেকে গেলেন ভারতেই। তাঁর ছেলে ‘স্যাম বাহাদুর’ও তাই এদেশেই রয়ে যান। আর পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠেন দেশের এক শ্রেষ্ঠ সন্তান।

ছোটবেলায় ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন স্যাম। লন্ডন থেকে ডাক্তারি পাশ করার ইচ্ছের কথা বাবাকে জানাতেই তিনি স্পষ্ট বলেন, এত অল্প বয়সে ছেলেকে তিনি ইংল্যান্ডে পাঠাতে চান না। তাছাড়া স্যামের দুই দাদা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বিদেশে। এই অবস্থায় আর এক ছেলেকেও বিদেশে পাঠানো তাঁর সাধ্যাতীত। এদিকে ১৯৩১ সালেই প্রতিষ্ঠিত হল ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমি। সেখানে ভর্তির পরীক্ষা দেন স্যাম। আর ফল বেরতেই দেখা গেল ৪০ জন নির্বাচিত ক্যাডেটের অন্যতম তিনি! পেয়েছেন ষষ্ঠ স্থান। জীবনের এই নাটকীয় মোড় স্যামের জন্য প্রস্তুত করে দিল ভবিষ্যতের মঞ্চ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে যায় এই মানুষটির জন্মই হয়েছে একজন খাঁটি সেনাকর্মী হওয়ার জন্য। পরবর্তী জীবনের প্রতিটি বাঁকে তা প্রমাণ করেছেন মানেকশ।

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে

[আরও পড়ুন: ‘সোনিয়াকে প্রণাম, খাড়গেকে নয়! দলিত বলেই?’ তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীকে খোঁচা বিজেপির]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বর্মায় (বর্তমান মায়ানমার) জাপানি সেনার সঙ্গে লড়াইয়ে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনার ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ছিলেন ‘স্যাম বাহাদুর’। আর সেই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের গুলিতে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যান তিনি। একটা-দুটো নয় নটা গুলি তাঁকে বিঁধে দিয়েছিল। ফুসফুস থেকে যকৃত, কিডনি থেকে অন্ত্র সবই বিশ্রীভাবে জখম হয়। দেড়দিন পড়ে ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। সঙ্গীর কাঁধে শেষপর্যন্ত ডাক্তারদের কাছে পৌঁছলেও আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন সকলে। তখনই সকলকে অবাক করে জ্ঞান ফিরে আসে মানেকশর। রীতিমতো রসিকতা করেই তিনি বলে ওঠেন ডাক্তারকে, ”আমাকে একটা গাধা লাথি মেরেছিল।”

এই হচ্ছেন মানেকশ। যিনি মৃত্যুর পাঁজরে লাথি মেরে ফিরে আসতে জানতেন। এই পজিটিভ মানসিকতাই তাঁকে প্রতিটি যুদ্ধে বীরবিক্রমে লড়াই করতে ও বিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধ, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন মানেকশ। কিন্তু স্বল্প পরিসরে সেই সব যুদ্ধে মানেকশর বীরত্বের খতিয়ানের দিকে না গিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের (Bangladesh) মুক্তিযুদ্ধর কথাতেই বরং আসা যাক। সেই অগ্নিগর্ভ সময়ের কথা কে না জানে। পাকিস্তানের করাল থাবার গ্রাস থেকে নিজেদের স্বাধীন করতে মরিয়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। সেই বিদ্রোহ রুখতে ‘বাংলাদেশের কসাই’ পাকিস্তানের (Pakistan) সেনাপ্রধান টিক্কা খান অবাধে হত্যালীলা চালাচ্ছেন।

Vicky-Sam-Bahadur-1
পর্দার স্যাম ভিকি কৌশল

এদেশের মসনদে তখন ইন্দিরা গান্ধী (Indira Gandhi)। ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে। এপ্রিল মাসে ক্যাবিনেট বৈঠক ডাকলেন প্রধানমন্ত্রী। টিক্কার নৃশংস অত্যাচারের থেকে পালাতে বহু শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন ভারতে। নয়াদিল্লি সতর্ক। কী করা যায় এই পরিস্থিতিতে। আর তাই বৈঠক। যে বৈঠকে অন্যদের সঙ্গে ছিলেন তদানীন্তন সেনাপ্রধান স্যাম মানেকশ। ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে সেদিনের বৈঠক। ইন্দিরা চাইছিলেন অবিলম্বে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে।

কিন্তু তাঁকে নিরস্ত করেন স্যাম। মনে করিয়ে দেন সেনার হাতে সেই মুহূর্তে রয়েছে মাত্র ৩০টি ট্যাঙ্ক। এই পরিস্থিতিতে যদি চিনও হামলা চালায়। তার উপর শিগগিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে পূর্ব পাকিস্তানে। নদী হয়ে যাবে সমুদ্র। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধে জেতা অসম্ভব। সটান প্রধানমন্ত্রীর মুখের উপরে স্যাম বলে ওঠেন, ”আই গ্যারান্টি ১০০ পার্সেন্ট ডিফিট।” জানা যায়, সেখানে আর কেউই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিন্নমত ছিলেন না। একা মানেকশই আটকে দেন তক্ষুনি যুদ্ধের পরিকল্পনা। জানান, তিনি ইস্তফা দিয়ে দেবেন। সেদিন ইন্দিরা কিন্তু মানেকশর প্রতি বিশ্বাস রেখেছিলেন। আর সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ে আট মাস পরে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয় দেশকে উপহার দিয়েছিলেন ‘স্যাম বাহাদুর’। সেই মাসের ১৬ তারিখ আত্মসমর্পণ করেন ৯৩ হাজার খান সেনা।

আজও স্মরণীয়

১৯৪২ সালে ‘সামরিক ক্রস’, ১৯৬৮ সালে পদ্মভূষণ এবং ১৯৭২ সালে পদ্মবিভূষণে ভূষিত হন স্যাম। তাঁর মৃত্যুর পর কেটে গিয়েছে পনেরো বছর। এখনও যে মানুষ তাঁকে একই ভাবে মনে রেখেছে, তা বুঝিয়ে দিচ্ছে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটি। যে ছবি ঘিরে আলোচনায় বার বার ফিরে এসেছেন স্যাম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের জেনারেল ছিলেন ইয়াহিয়া খান। দেশভাগের আগে দুজনেই ছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে। দেশভাগের পরে ইয়াহিয়া পাকিস্তানে চলে যান। তবে যাওয়ার আগে তিনি স্যামের লাল মোটরসাইকেলটিও সঙ্গে নিয়ে যান। কথা ছিল সেটার মূল্য বাবদ এক হাজার টাকা তিনি দেবেন স্যামকে। কিন্তু সেই টাকা আর পাওয়া যায়নি। ১৯৭১ সালে যুদ্ধজয়ের আনন্দে স্যাম এক সরস মন্তব্য করেছিলেন। ”২৪ বছর ধরে অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্ত চেক আর আসেনি। শেষপর্যন্ত ১৯৪৭ সালে নেওয়া ঋণ ও চুকিয়ে দিল অর্ধেকের বেশি পাকিস্তান আমাদের দিয়ে।” এমন রসবোধ ও দুর্দান্ত সাহসিকতা ইতিহাসের ভিতরে ‘গল্প হলেও সত্যি’ হয়ে স্মরণীয় রেখে দিয়েছে স্যামকে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement