বিশ্বদীপ দে: মিজোরামে প্রায় ‘সমান্তরাল সরকার’ চালাচ্ছিলেন লালডেঙ্গা। সেই সমস্যার সমাধানে অজিত ডোভালের ভূমিকা ও কৌশল আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। একই রকম ভাবে তিনি সামলেছিলেন সিকিমের ক্রাইসিসও। লালডেঙ্গাই হয়েছিলেন মিজোরামের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। বলা হয়, সেদিন ডোভাল না থাকলে ওই বিদ্রোহকে দমন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াত। প্রায় একই সময়ে মাথাচাড়া দিয়েছিল সিকিমের সমস্যাও। আর সেখানেও ডাক পড়েছিল ডোভালেরই।
১৯৭৫ সালের ১৬ মে সিকিম সরকারি ভাবে ভারতের ২২তম রাজ্য হিসেবে ঘোষিত হয়। দিনটি আজও পালিত হয় সিকিম দিবস হিসেবে। আসলে ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় থেকে সিকিমও (Sikkim) ভারতের অংশ ছিল। সেখানকার বিদেশ নীতি, প্রতিরক্ষা ইত্যাদির দায়িত্ব ছিল ভারত সরকারেরই। কিন্তু তাও চোগিয়াল বংশের রাজাদের দ্বারা শাসিত একটি স্বাধীন ভূখণ্ডই ছিল উত্তর-পূর্বের রাজ্যটি। সাতের দশকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী (Indira Gandhi) চাইছিলেন সিকিম পুরোপুরি ভারতের এক অঙ্গরাজ্য হয়ে উঠুক। বাধ সাধছিলেন সিকিমের রাজা পালডেন থনডুপ নামগ্যাল। শেষ পর্যন্ত অজিত ডোভালের সৌজন্যেই তা সম্ভব হয়। ১৯৭৪ সালে মিজোরামের সমস্যার সমাধান হওয়ার পরে ডোভালকে পাঠানো হয় সিকিমে।
১৯৭১ সালে সিকিম সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব ইন্দিরা প্রথমে দিয়েছিলেন ‘র’ প্রধান আর এন কাওকে। তিনি একটি পরিকল্পনাও করেন। ওখানকার স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলির সাহায্যে রাজার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সিকিমে নির্বাচনের পরিস্থিতি করা হবে। তারপর বিধানসভায় বিল পেশ করে সিকিমকে ভারতের সঙ্গে পুরোপুরি ভাবে যুক্ত করা হবে। এদিকে সিকিমের রাজার বউ মার্কিন তরুণী হোপ কুক। একজন সাধারণ মহিলা কী করে রাজরানি হয়ে উঠলেন ভেবে উঠতে পারছিল না ওয়াকিবহাল মহল। এমনও শোনা যাচ্ছিল ওই মহিলা নাকি সিআইএ এজেন্ট। এই গুঞ্জনে ভারত সরকারের চিন্তা বাড়ছিল। হোপ কুক দাবি করতে লাগলেন, দার্জিলিংকে সিকিমের অন্তর্ভুক্ত করা হোক। ফলে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছিল। কেন্দ্র চাইছিল দ্রুত সিকিমকে ভারতের অঙ্গরাজ্য ঘোষণা করতে।
এই অবস্থায় ১৯৭৪ সালে সিকিমের দায়িত্ব পান অজিত ডোভাল। তিনি ওখানে পৌঁছেই একটি দল গড়ে তোলেন। সেই দলটির দায়িত্বই ছিল সিকিমের মানুষের মধ্যে ভারতীয়ত্বের আবেগকে জাগিয়ে তোলা। তাঁদের বোঝানো ভারতীয় গণতন্ত্রের অংশ হলে কী কী সুবিধা পাবেন তাঁরা। সেই সময় সিকিমের সবচেয়ে বড় দল সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস। এই দলের পাশে দাঁড়াল টিম ডোভাল। সেখানকার ছোট ছোট দলগুলিকেও এসএনসি’র সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হতে থাকে। ক্রমে পরিস্থিতি নির্বাচনের অনুকূল হয়ে ওঠে। এসএনসিই ভোটে জেতে। কাজি দোরজিকে সিকিমের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ততদিনে রাজার ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
দেখতে দেখতে রাজা ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দোরজি ভারত সরকারের কাছে আরজি জানান হস্তক্ষেপের। সেইমতো ভারতীয় সেনা ঘিরে ফেলে রাজার বাড়ি। ‘সিজ’ করে দেওয়া হয় সীমানা। এরপর সিকিমে হয় রেফারেন্ডাম তথা গণভোট। ৯৫ শতাংশ সিকিমবাসীই ভারতের সঙ্গে থাকার পক্ষে সায় দেন। সিকিম হয়ে ওঠে ভারতের অঙ্গরাজ্য। পুরো বিষয়টিতেই ডোভালের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। তাঁর নেতৃত্বাধীন দলই সেদিন সিকিমের মানুষের মনে গণতন্ত্রের প্রতি ভালবাসার বীজ পুঁততে পেরেছিল।
এইভাবে দেশের রাজ্যগুলির সমস্যার ক্ষেত্রে মুশকিল আসান হয়ে দাঁড়ানোর ফলে অচিরেই ‘ভারতের জেমস বন্ড’ হয়ে ওঠেন ডোভাল (Ajit Doval)। আরও দেড় দশক পরে ১৯৯০ সালে কাশ্মীর সমস্যা তাঁর কাছে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই সময় উপত্যকার বুকে দাপাদাপি চলছে ইখওয়ান-ই-মুসলিমিন নামের এক দলের। পাক মদতপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সর্বেসর্বা কুকা পারে। এখানেও মাস্টারস্ট্রোক ডোভালের। উর্দু ও আরবী ভাষায় দক্ষ ডোভাল দলটির সঙ্গে মিশে গিয়ে ভাব জমিয়ে তুললেন খোদ কুকা পারের সঙ্গেই। এমনই তাঁর কথা বলার ক্ষমতা, পাকিস্তানের (Pakistan) চর কুকা হয়ে উঠতে লাগলেন পাক-বিরোধী! ক্রমে কাশ্মীরে ফিরতে থাকে গণতন্ত্রের পথ। ১৯৯৬ সালে নির্বাচন হল জম্মু ও কাশ্মীরে। ভোটে জিতে সেখানকার বিধায়ক হন কুকা পারে। জঙ্গি নেতা থেকে বিধায়ক- তাঁর এই পরিবর্তন ও কাশ্মীরে নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পিছনে একটাই নাম। অজিত ‘জেমস বন্ড’ ডোভাল।
ইয়ান ফ্লেমিং সৃষ্ট চরিত্রটির অবশ্য বন্দুকেই বেশি আগ্রহ। কিন্তু ‘লাইসেন্স টু কিল’ থাকা এক এজেন্টের সঙ্গে ডোভালের এখানেই পার্থক্য। তাঁর আসল অস্ত্র ফেলু মিত্তিরের মতোই ‘মগজাস্ত্র’। ইয়াসিন মালিক, শাব্বির শাহের মতো বহু জঙ্গিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সন্ত্রাসের পথ থেকে সরিয়ে সমাজের মূলস্রোতে ফেরাতে সেই ক্ষুরধার অস্ত্রকেই কাজে লাগিয়েছিলেন ডোভাল। যা আজ প্রায় মিথে পর্যবসিত হয়ে গিয়েছে।
এবার অমৃতসর ও খলিস্তানিদের কথা। ১৯৮৪ সালের ‘অপারেশন ব্লুস্টারে’র বদলা নিতে ফের স্বর্ণমন্দিরের দখল নিচ্ছিল শিখ উগ্রপন্থীরা। তাদের কবল থেকে স্বর্ণমন্দিরকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পরিকল্পনা করা হয় ‘অপারেশন ব্ল্যাক থান্ডারে’র। এই অপারেশনের নেপথ্যেও সেই অজিত ডোভাল। ছদ্মবেশ নিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। পাকিস্তানের রাস্তায় রাস্তায় ভিখারির বেশে তিনি ঘুরেছিলেন। এবার ডোভাল ধরলেন রিকশা চালকের ভেক। স্বর্ণমন্দিরের সামনের রাস্তায় চক্কর কাটতে থাকা সেই রিকশা চালককে দেখে সেনার চর ভেবে ভিতরে তুলে নিয়ে যায় খলিস্তানিরা। কিন্তু চোস্ত উর্দুতে সেই চালক দাবি জানাতে থাকে সে আসলে তাদেরই লোক। পাকিস্তান তাকে পাঠিয়েছে। ভারতীয় সেনা নয়, সে আইএসআইয়ের লোক।
লুঙ্গি পরিহিত সেই লোকটি ক্রমেই ‘কনভিন্স’ করে ফেলে ভয়ংকর জঙ্গিদের। আসলে ততদিনে পাকিস্তানে বছরের পর বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে ডোভালের। সেই অভিজ্ঞতার ঝুলি উপুড় করে তিনি বোঝাতে সক্ষম হলেন, পাকিস্তানেই থাকেন তিনি। ফলে তাঁর ‘অভিনীত’ রিকশা চালকের ছদ্মবেশে পাক জঙ্গির চরিত্রটিকে সত্য়ি ভাবার চরম ভুল করে ফেলল খলিস্তানিরা। সহজেই সেই আগন্তুককে বিশ্বাস করে সব গোপন তথ্যের ঝুলি তার হাতে তুলে দিল তারা। আর সেই ‘আইএসআই অফিসার’ও ভারতীয় সেনার কাছে সেই তথ্য পাঠিয়ে দিতে লাগল। ডোভালের কৌশলে এভাবেই ‘এক্সপোজ’ হয়ে গেল খলিস্তানিদের সব মতলব।
এরপর ১৯৮৮ সালের মে মাসে শুরু হল ‘অপারেশন ব্ল্যাক থান্ডার’। পাঞ্জাব পুলিশের প্রধান কেপিএস গিলের নেতৃত্বে হওয়া সেই অপারেশনে খতম হয়েছিল চল্লিশের বেশি জঙ্গি। আত্মসমর্পণ করেছিল দুশোরও বেশি। সেই অপারেশন চলাকালীন তারা খুঁজে বেরিয়েছিল সেই ‘বন্ধু পাকিস্তানি’কে। কিন্তু সেই রিকশা চালককে কি আর স্বর্ণমন্দিরে পাওয়া যাবে? তার কাজ যে শেষ। গোপন তথ্য জেনে নিয়ে সেনাকে জঙ্গিদের সব হাল হকিকত জানানোর কাজ নিপুণ ভাবে করে সেই অপারেশনের সাফল্যের অন্যতম কারিগর হয়ে উঠেছিলেন ডোভাল। তাঁর মুকুটে যুক্ত হয়েছিল নয়া পালক।
এভাবেই কেরল থেকে শুরু করে মিজোরাম, সিকিম, কাশ্মীর, পাঞ্জাব- একে একে বিভিন্ন রাজ্যের জটিল সমস্যার মোকাবিলা করেছিলেন ডোভাল। তবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ‘জার্নি’ বোধহয় পাকিস্তানে। শত্রু দেশে মুসলিম সাজতে গিয়ে প্রায় ধরাও পড়ে গিয়েছিলেন। দিনের পর দিন কাটিয়েছেন ভিখারির ছদ্মবেশে। সেই ‘সিনেমার মতো গল্প’ আগামী সপ্তাহে।
(ক্রমশ)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.