দীপেন্দু পাল: মাত্র চার বছরের ব্যবধানে ভারতের অন্তত ১১ জন কৃতী ও অত্যন্ত সফল পরমাণু বিজ্ঞানী রহস্যজনকভাবে মারা গিয়েছেন। ভারতের ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জির এই তথ্য প্রকাশ্যে আসায় চমকে উঠেছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশ। ১৯৬৬ সালে ভিয়েনাগামী এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং-৭০৭ বিমান ভেঙে পড়লে ভারতের পরমাণু গবেষণার জনক হোমি জাহাঙ্গির ভাবা-সহ ১১৭ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়। ওই মৃত্যুর পিছনে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর হাত থাকার জল্পনা ওঠার পরই নতুন করে একটি পরিসংখ্যান ফের ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন মহলে। বছর দু’য়েক আগে সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের সেই রিপোর্টকে ঘিরে নতুন করে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে।
ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জির একটি রিপোর্টকে উদ্ধৃত করে পিটিআই জানায়, ২০০৯-১৩ সালের মধ্যে ১১জন পরমাণু বিজ্ঞানী ও বেশ কযেকজন ইঞ্জিনিয়ার অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে মারা গিয়েছেন। কেউ জলে ডুবে, কেউ আবার গলায় দড়ি দিয়ে। হরিয়ানার বাসিন্দা রাহুল শেহরাওয়াতের একটি আরটিআইয়ের জবাবে এই পরিসংখ্যানটি প্রকাশ্যে আসে। আর তার পর থেকেই শুরু হয় প্রবল চাঞ্চল্য। মৃতদের মধ্যে এমন তিনজন পরমাণু বৈজ্ঞানিক রয়েছেন, যাঁরা দেশের পারমাণবিক গবেষণাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ভারতের নিউক্লিয়ার পাওয়ার কর্পোরেশনের এই তিন বৈজ্ঞানিকের মধ্যে দু’জন আত্মহত্যা করেছেন, একজন মারা গিয়েছেন পথ দুর্ঘটনায়। কোনওক্ষেত্রেই মৃত্যুরহস্যের সমাধান মেলেনি।
মৃতদের মধ্যে দু’জন কর্মসূত্রে ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার বা বার্কের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১০-এ নিজেদের বাসভবন থেকে তাঁদের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। রাওয়াতভাতায় কর্মরত সি-গ্রুপেরই আর এক বৈজ্ঞানিকের দেহ উদ্ধার হয় ২০১২-য়। প্রথম ঘটনাটির ক্ষেত্রে পুলিশ দাবি করে, অবসাদে ভুগে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ওই গবেষকরা, কিন্তু এই দাবি মানতে নারাজ মৃতদের আত্মীয়-পরিজনরা। অন্যান্য ক্ষেত্রে মৃত্যুরহস্যের কোনও সমাধান এখনও মেলেনি। ২০১০-এ বার্কেরই দু’জন গবেষকের মৃত্যু হয়। রসায়ন বিভাগের গবেষণাগারে কোনও এক অজ্ঞাতকারণে ভয়াবহ আগুন লাগে। সেই আগুনে পুড়েই মৃত্যু হয় ওই দুই গবেষকের, দাবি স্থানীয় পুলিশের। এফ-গ্রেডের এক পরমাণু বৈজ্ঞানিক রহস্যজনকভাবে মারা যান তাঁরই মুম্বইয়ের বাসভবনে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই রহস্যের কোনও সমাধান হয়নি। RRCAT-তে কর্মরত এক ডি-গ্রেড বৈজ্ঞানিক আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি জানিয়ে পুলিশ ওই মামলাও বন্ধ করে দেয়।
এখানেই তালিকার শেষ নয়। ২০১৩-য় কালাপক্কমে কর্মরত আর একজন বৈজ্ঞানিক সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে মারা যান। ওই ক্ষেত্রেও ব্যক্তিগত কারণে আত্মহত্যার যুক্তি দেখিয়ে পুলিশ মামলাটি ঝুলিয়ে রাখে। ওই মামলার কোনও সুরাহা এখনও হয়নি। কর্নাটকের কালী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আরও এক বৈজ্ঞানিক মারা যান। উপরের সবক’টি ঘটনার মতো পুলিশ এক্ষেত্রেও আত্মহত্যার যুক্তি দেয়।
উপরের সবক’টি ঘটনাতেই রয়ে গিয়েছে জমাট বাঁধা রহস্য। পুলিশ, কেন্দ্রীয় সরকার বা কোনও রাজ্য সরকার ওই সমস্ত বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানীদের মৃত্যুরহস্য নিয়ে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য তথ্যই প্রকাশ্যে আনেনি। এই সমস্ত ঘটনা হয়তো লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যেত। কিন্তু হোমি জাহাঙ্গির ভাবার রহস্যমৃত্যু নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে আসতেই নড়েচড়ে বসেছে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম। একটি বইয়ে সাংবাদিক গ্রেগরি ডগলাস ও প্রাক্তন সিআইএ আধিকারিক রবার্ট ক্রোলের কথোপকথনের সূত্র ধরে মেলে এক ভয়াবহ ইঙ্গিত। ভারতের পরমাণু গবেষণাকে ‘পঙ্গু’ করতেই নাকি ভাবাকে নিকেশের ছক কষে সিআইএ। এয়ার ইন্ডিয়া ৭০৭-কে ‘ধ্বংস’ করতে কোনও যুদ্ধবিমান বা মিসাইলও ব্যবহার করা হতে পারে বলে দাবি করছেন কেউ কেউ। ডগলাস ও ক্রোলের কথোপকথনে শোনা যায়, ভাবা যেভাবে ভারতের পারমাণবিক গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে আমেরিকা। তবে কি আমেরিকাই মিসাইল দেগে উড়িয়ে দেয় ভাবা-র বিমান, রহস্য কিন্তু রয়েই গিয়েছে। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে আল্পস পাহাড়ে ভেঙে পড়ে বিমানটি। ভাবা-সহ ১১৭ জন যাত্রীরই মৃত্যু হয়।
প্রসঙ্গত, মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগে অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে হোমি জাহাঙ্গির ভাবা ঘোষণা করেছিলেন, কেন্দ্র যদি সবুজ সংকেত দেয়, তাহলে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে পরমাণু বোমা তৈরি করার ক্ষমতা রাখে ভারত। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, হোমি জাহাঙ্গির ভাবা মনে করতেন, আগামী দিনে ভারতকে যদি শক্তিধর দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হয়, তাহলে বিদ্যুৎ, কৃষি, ওষুধের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরমাণবিক শক্তির ব্যবহার করতে হবে। আর সেই পরিকল্পনার সূত্রে ধরেই গোপনে তিনি পরমাণু বোমাও তৈরি করতে চেয়েছিলেন বলে শোনা যায়। বিমান দুর্ঘটনায় হোমি জাহাঙ্গির ভাবার মৃত্যুর আট বছর পর, ১৯৭৪ সালে মে মাসে পোখরানে পরীক্ষামূলকভাবে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটায় ভারত।
এবার আসা যাক, গত কয়েক বছরে যে যে পরমাণু বৈজ্ঞানিকদের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের প্রজেক্টের বিষয়ে।
লোকনাথন মহালিঙ্গম: অসমর্থিত সূত্রে খবর, ২০০৯-এর ১৩ জুন পরমাণু বিজ্ঞানী লোকনাথন মহালিঙ্গমের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। খুব অল্প লোকই তাঁর নাম জানতেন বা তাঁকে চিনতেন। মহালিঙ্গম গত আটবছর ধরে কর্নাটকের কাইগা অ্যাটমিক পাওয়ার স্টেশনে প্রজেক্ট ‘সি-বার্ড’ নিয়ে অত্যন্ত গোপনে কাজ চালাচ্ছিলেন। এটি একটি সামরিক প্রজেক্ট ছিল। তৎকালীন ভারতে আটটির মধ্যে চারটি পারমাণবিক চুল্লিই ছিল কাইগাতেই। সবকটি চুল্লিই ছিল আন্তর্জাতিক মহলের নজরের বাইরে। ৪৭ বছরের মহালিঙ্গম ৮ জুন সকালে প্রতিদিনের মতোই কাইগা পাওয়ার স্টেশনে যান, কিন্তু আর ফিরে আসেননি। পাঁচদিন পর তাঁর পচাগলা মৃতদেহ কালী নদী থেকে উদ্ধার হয়। পুলিশ আত্মহত্যার যুক্তি দিলেও তাঁর পরিবার সেই যুক্তি মানতে চায়নি।
উমা রাও: ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের অবসরপ্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক ৬৩ বছরের উমা রাও নিজ বাসভবনে আত্মহত্যা করেন বলে জানায় পুলিশ। অবসাদে ভুগে আত্মহত্যা বলে পুলিশ দাবি করলেও উমা রাওয়ের সহকর্মীরা ওই সদাহাস্য বৈজ্ঞানিকের মধ্যে অবসাদের কোনও চিহ্ন দেখতে পাননি।
রবি মুলে: নিউক্লিয়ার পাওয়ার কর্পোরেশন ইন্ডিয়া লিমিটেডের আর এক কর্মী রবি মুলে প্রথমে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান, পড়ে তিনি খুন হয়েছেন বলে জানায় পুলিশ। যদিও নিহতর ভাই এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন।
এম আইয়ার: ২০১০-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের ইঞ্জিনিয়ার এম আইয়ারকে তাঁরই বাসভবনে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তিনিও একটি গোপন নিউক্লিয়ার প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অথচ তাঁর মৃত্যুরহস্যের জট ছাড়াতেই পারেনি পুলিশ। এমনকী, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা নাকি তাঁর মৃতদেহের চারপাশ থেকেও কোথাও কোনও আঙুলের ছাপ পাননি।
কে কে যোশী ও অবিনাশ শিভম: এই দুজন কৃতী বৈজ্ঞানিকের মতো চাঞ্চল্যকর মৃত্যু রহস্য খুব একটা দেখা বা শোনা যায়নি। ভারতের নিউক্লিয়ার সাবমেরিন আইএসএস অরিহন্তের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন এই দুই প্রতিভাবান। ২০১৩-র অক্টোবরে বিশাখাপত্তমের রেললাইনের উপর এদের মৃতদেহ পড়ে ছিল। কিন্তু তাঁরা রেলের ধাক্কায় মারা যাননি। অথচ তাঁদের শরীরেও কোনও বাহ্যিক আঘাতের চিহ্নও নাকি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
উমং সিং ও পার্থপ্রতীম বাগ: ২০০৯-এর ৩০ অক্টোবর বার্কের রসায়নাগারে রহস্যজনকভাবে আগুনে পুড়ে এঁদের মৃত্যু হয়। অথচ যে ল্যাবে এই দু’জন সেদিন কাজ করছিলেন, সেখানে কোনও দাহ্য পদার্থই নাকি ছিল না। পার্থবাবু বা উমং- কারও পরিবারই তাঁদের মৃত্যুর আসল কারণ জানতে পারেনি।
মহম্মদ মুস্তাফা: কালাপক্কমের ইন্দিরা গান্ধী সেন্টার ফর অ্যাটমিক রিসার্চের ২৪ বছরের তরুণ তুর্কি মহম্মদ মুস্তাফার মৃতদেহ মেলে তাঁরই বাসভবনে। তাঁর হাতের কবজি কাটা অবস্থায় দেহ উদ্ধার হয়। পুলিশ আত্মহত্যার তত্ত্ব খাড়া করলেও এই মৃত্যুর আসল কারণ আজও জানা যায়নি।
তিতাস পাল: বার্কের ২৭ বছরের এই বৈজ্ঞানিকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় মুম্বই থেকে। বার্ক ক্যাম্পাসের নীলগিরি বিল্ডিংয়ের ঘরে তাঁকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় মেলে। বারবার ফোন করেও সাড়া না পেয়ে তাঁর বাবা পুলিশে খবর দেন। অথচ সেই রহস্য আজও উদ্ধার হয়নি।
ডালিয়া নায়েক: সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের বর্ষীয়ান বৈজ্ঞানিক নাকি রাসায়নিক খেয়ে আত্মহত্যা করেন। অবসাদই কারণ বলে জানায় পুলিশ। অথচ তাঁর বন্ধুরা জানান, ডালিয়া একজন হাসিখুশি স্বভাবের মানুষ ছিলেন।
এছাড়াও বার্কের আরও পাঁচ পরমাণু বৈজ্ঞানিকের রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়। তাঁরা হলেন, অবদীশ চন্দ্র(২০০০ সালে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার তত্ত্ব), আশুতোষ শর্মা ও সৌমিক চৌধুরি (২০১০-এ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার তত্ত্ব), অক্ষয় পি চবন (২০১০-এর এপ্রিলে বাড়ির ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার তত্ত্ব), সুভাষ সোনাওয়ানে। এছাড়াও বিভিন্ন গোপন সামরিক প্রজেক্টে যুক্ত থাকা বেশ কয়েকজন ভারতীয়র অস্বাভাবিক মৃত্যুর আসল কারণ এখনও জানা যায়নি। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন তিরুমালা প্রসাদ তেনকা, বলদেব সিং(হ্যালের চিফ পাইলট)-সহ আরও বেশ কয়েকজন।
এখন প্রশ্ন হল, ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের এতজন প্রথিতযশা পরমাণু বৈজ্ঞানিকের মৃত্যু কীভাবে হল, সেটা জানতে কেন উদ্যোগী হল না কেন্দ্র বা স্থানীয় প্রশাসন? প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। বিশেষত, যে সব প্রজেক্টে ভারতের সঙ্গে আমেরিকাও নিবিড়ভাবে যোগাযোগ রেখে চলেছে, সেই সব ক্ষেত্রেই যেন রহস্যজনকভাবে মৃতের তালিকা লম্বা হয়েছে। তবে কি ভারতের পারমাণবিক গবেষণাকে রুখতে সত্যি তলে তলে কাজ চালাচ্ছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা? এবিষয়ে এখনই কোনও সরকারি তথ্য না মিললেও এই তত্ত্ব কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.