নব্যেন্দু হাজরা, বালেশ্বর: থরে থরে পড়ে দেহ। কেউ বাঙালি। কেউ বা বিহারী। কারও বাড়ি ওড়িশা বা তামিলনাড়ুতে। শাপগ্রস্ত করমণ্ডল (Coromandel Express)-হামসফরের যাত্রী ছিলেন তাঁরা। এখন পরিচয়, কতকগুলি নম্বরে। রাখা হয়েছে বাহানাগা হাই স্কুলে। বাইরে তাপমাত্রা তখন সাঁইত্রিশ ছুঁয়েছে। বাতাসে তাতাপোড়া আপেক্ষিক আর্দ্রতা। তবে পড়ে থাকা দেহগুলোর তা বোঝার অনুভূতি নেই। নিথর-নিষ্পন্দ। করমণ্ডল-হামসফর এক্সপ্রেসের (Humsafar Express) সংঘর্ষে নিশ্চল হয়ে গিয়েছে মানুষগুলো।
শুক্র সন্ধেয় শিউরে ওঠার মতো ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে প্রায় শ’তিনেক মানুষের। কাউকে শনাক্ত করা গিয়েছে। দুর্ঘটনায় কারও মুখ থেঁতলে, পিষে এমন হয়ে গিয়েছে যে চেনার উপায়ও নেই। শনিবার সকালে উদ্ধারকার্য শুরু হতেই প্রথমেই ভাবতে হয়, এসব বিকৃত দেহ কোথায় রাখা হবে? চোখে পড়ে বাহানাগা বাজার হাই স্কুল। দুর্ঘটনাস্থল থেকে এই স্কুলের দুরত্ব হাঁটাপথে মিনিট দু’য়েক। শবদেহ রাখার জন্য প্রাথমিকভাবে সে জায়গাকেই বেছে নেয় বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মীরা। একের পর ক্ষত বিক্ষত দেহ আনা হয় দুঘর্টনাস্থল থেকে। দেহ তো একটা দুটো নয়। হিসেব রাখার জন্য, চাদর মুড়িয়ে গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয় নম্বর। ১২১,১২২,১২৩…। এতদিনের নাম-পরিচয় সব বদলে দিয়েছে শুক্রবার রাতের দুর্ঘটনা। প্রাণহীন দেহগুলো এখন স্রেফ এক একটা নম্বর।
মৃত্যু মিছিল এতেটাই ভয়াবহ। এক ঘন্টার মধ্যে সে লাশ রাখার জায়গাতেও তিল ধারণের জায়গা নেই। হাই স্কুলের লাশঘরের দায়িত্বে থাকা এনডিআরএফ (NDRF) কর্মী খবর দেয়, ‘‘অউর লাশ রাখনে কা জাগা নেহি হ্যায়।’’ ততক্ষণে গায়ে গায়ে ঠেলে ঠুলে প্রায় গোটা পঁচাত্তর লাশ জমা হয়েছে বাহানাগা হাইস্কুলের ক্লাসরুমে। সেখানেই পরিবারের হারিয়ে যাওয়া সদস্যকে খুঁজতে ঢুকছেন একে একে। মৃতদেহের মুখের চাদর সরিয়ে সরিয়ে সে খোঁজার দৃশ্যও প্রাণান্তকর। মাঝে মাঝেই ভেসে আসছে ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দ। লাশ ঘেঁটে কেউ খুঁজে পেয়েছেন নিজের বাবা-কাকাকে। ক্যানিংয়ের সামসুদ্দিন সর্দারকে যেমন খুঁজে পেয়েছেন তাঁর ছেলে। ট্রেনে চেপে কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছিলেন তিনি। দুর্ঘটনায় সব শেষ। সামসুদ্দিনের পরিবার জানিয়েছে, খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শেষে দেখলাম ক্লাসরুমে পড়ে রয়েছে দেহটা।
বিস্মিত এলাকার বাসিন্দা বিরবির করেন, এ হাইস্কুল না শবগৃহ! আপাতত স্কুলে গরমের ছুটি। যে ক্লাসরুম কচিকাচাদের আওয়াজে মুখর হয় সেখানেই শশ্মানের স্তব্ধতা। আপনহারাদের আনাগোনা। বাহানাগা খেলার মাঠের অবস্থাও একই রকম। পচা মৃতদেহের গন্ধে নাকে রুমাল চাপা দিতে হয়। চাদর ঠেলে বেরিয়ে আসছে রক্তরস। স্কুলের কর্মচারীরা জানিয়েছেন, এমন দৃশ্য যে দেখতে হবে তা জীবনে কল্পনা করতে পারেননি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.