বিশ্বদীপ দে: ইতিহাস বললেই সাধারণ ভাবে সন-তারিখ কিংবা রাজারাজড়ার উত্থান-পতনের শুকনো তথ্যের কথা মনে আসে। কিন্তু ইংরাজিতে যাকে বলে ‘বিটুইন দ্য লাইনস’ সেখানে জ্বলে থাকে মানুষের বিজয়গাথার মশাল। বছরের পর বছর প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রিটিশরাজের শিকল পায়ে পরেও যে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন এই দেশের অসংখ্য সাধারণ মানুষ, শোষণের কুটিল কামড়েও তাঁদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরানো যায়নি, সে সাক্ষ্যও রয়ে গিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে। তবু… পঠিত ইতিহাস কি সবটুকু তুলে ধরে আমাদের চোখের সামনে? ইতিহাসের নানা উজ্জ্বল অধ্যায়ের আড়ালে যে চাপা পড়ে রয়েছে বহু বিস্মৃতি, সেকথাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। আপনি কি মানগড়ের নাম শুনেছেন? সম্ভবত না। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের (Jallianwala Bagh massacre) বীভৎসতা ছোটবেলা থেকেই ইংরেজের নিষ্ঠুর শোষক চেহারাকে আমাদের সামনে উদোম করে দেয়। কিন্তু ‘মানগড় গণহত্যা’ (Mangarh Massacre) যে তার চেয়েও ভয়ংকর। যা ঘটেছিল জালিয়ানওয়ালাবাগেরও বছর ছয়েক আগে। অথচ ইতিহাসের প্রচলিত ধারাপথে ঠাঁই মেলেনি তার।
কেন এই আশ্চর্য বৈপরীত্য? কেন ইতিহাস মুখ ফিরিয়ে রেখেছে রাজস্থান (Rajasthan) ও গুজরাটের (Gujarat) মধ্যবর্তী আরাবল্লি পর্বতের সানুদেশে ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুরতম গণহত্যার দগদগে এই অধ্যায় থেকে? সেকথায় পরে আসা যাবে। আগে বিস্তৃত ভাবে এই আপাত অন্ধকার ইতিহাসের দিকে একবার চোখ রাখা যাক। জঙ্গলে ঘেরা আদিবাসী অধ্যুষিত স্থানে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের খলনায়ক কেবল ইংরেজরা নয়। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল দেশীয় রাজারাও। তাদের টার্গেট ছিল প্রাচীন ভারতবর্ষের আদিম জনজাতি ভীল সম্প্রদায়ের মানুষরা। তাদের ‘অপরাধ’ তারা ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেছিল। আর ইতিহাস সাক্ষী, সাধারণ মানুষ যখন তার বিরুদ্ধে চলতে থাকা নিপীড়নের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে রুখে দাঁড়ায়, তখনই ঝলসে ওঠে শাসকের মরিয়া তরবারি।
অথচ ভীলরা যে এমন সঙ্ঘবদ্ধ হতে পারে কে কবে ভেবেছিল? ওদের তো নিয়তিই জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে শিকার কিংবা পশুচারণ। আর না হলে ভূস্বামী তথা সমাজের প্রভাবশালীদের দাসত্ব। সমাজের উচ্চশ্রেণির চোখে এর বেশি কিছু বরাদ্দ ছিল না। এদিকে ১৯০০ সালের খরায় কার্যত সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছিল ভীলরা। ফলে যেটুকু খুদকুঁড়ো, সেটুকুও যেতে বসার জোগাড়। বিশেষ করে রাজস্থানের বাঁশোয়ারা ও শান্তারামপুর নামে দুই দেশীয় রাজ্যের পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে খারাপ। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানির পথে যেতে যেতে দেশীয় মদে আকণ্ঠ ডুবে যাচ্ছিল তারা।
খাদের কিনারে ঝুঁকে পড়া বিপন্ন ভীলদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এক নায়ক। অন্ত্যজ ভারতবর্ষের হৃদয় থেকে উঠে আসা সেই নায়কের নাম গোবিন্দ গিরি। তাঁরও নিয়তি তাঁকে এক গড়পড়তা ভীলের মতোই জীবন দিয়েছিল। কিন্তু বাঁধা দাসত্ব তাঁর নিয়তি ছিল না। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের মনে তিনি জ্বেলে দিয়েছিলেন বিপ্লবের আগুন। ‘অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবিতে’ তিনি একত্রিত করছিলেন ওই অঞ্চলের সমস্ত ভীলকে। ভূস্বামীরা বুঝতে পারছিলেন, এভাবে চললে আর দেখতে হবে না। চাষবাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। শাসক ইংরেজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ধীরে ধীরে তৈরি হল চক্রান্তের কাহিনি।
এদিকে ততদিনে এগিয়ে এসেছে ১৯১৩ সালের নভেম্বর। অক্টোবরেই জয়পুর থেকে সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মানগড়ে পৌঁছন গোবিন্দ গিরি ও তাঁর অনুগামীরা। বসতি গেড়েছেন বাঁশোয়ারা ও শান্তারামপুর লাগোয়া ঘন জঙ্গলে, আরাবল্লির সানুদেশে। ক্রমেই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল ওই দুই দেশীয় রাজ্যের রাজা ও ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে সকলকে ওখানে একজোট করছেন গোবিন্দ গিরি। হয়তো তিনি গঠন করবেন স্বাধীন এক ভীল রাজ্য। স্বাভাবিক ভাবেই প্রমাদ গুণে রাজারা দ্বারস্থ হল ইংরেজদের। ব্রিটিশদের পলিটিক্যাল এজেন্ট হ্যামিল্টন সাহেব সাড়া দিলেন সেই আহ্বানে।
১৯১৩ সালের ১৭ নভেম্বর। দিনটা কার্তিক পূর্ণিমা। ভীলদের মঙ্গলকামনায় বিরাট এক যজ্ঞের আয়োজন হয়েছিল গভীর জঙ্গলে। আর ইংরেজ সেনাপতিরা আয়োজন করলেন নিধন যজ্ঞের। ভারী ভারী মেশিনগান থেকে কামান- জোগান ছিল সব কিছুরই। তারপর এক নিমেষে শুরু হয়ে গেল গুলিবর্ষণ। অবিকল আরেক জালিয়ানওয়ালাবাগ। চোখের সামনে খসে পড়তে লাগল নিরীহ প্রাণ। শয়ে শয়ে। জানা যায়, সব মিলিয়ে লাখখানেক মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছিল। বন্দুকের গুলি আর কামানের গোলায় সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন হাজার দেড়েক মানুষ। বহু মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ছুটতে গিয়ে গড়িয়ে পড়েছিলেন পাহাড়ের বুক থেকেও।
অচিরেই গোবিন্দ গিরি ও তাঁর বহু অনুগামীকে গ্রেপ্তার করা হল। অভিযোগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। ১৯১৪ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হল গোবিন্দকে। যদিও শেষ পর্যন্ত ১৯১৯ সালেই মুক্তি দেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু নিজভূমে ততদিনে তিনি পরবাসী। কোনও দেশীয় রাজাই তাঁকে নিজেদের রাজ্যে থাকার অনুমোদন দেননি। ১৯৩১ সালে গুজরাটে মারা যান গোবিন্দ গিরি। পরাধীন ভারতবর্ষের বুকে অন্ত্যজ মানুষদের অধিকারের স্বাধীনতা চেয়ে যে লড়াই তিনি করেছিলেন তা যেন চাপাই পড়ে রইল।
অথচ মৃত্যু ও বীভৎসতার বিচারে জালিয়ানওয়ালাবাগকেও যেন ছাপিয়ে যায় মানগড় গণহত্যা। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনায় জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে ইংরেজ সেনাদের গুলিতে যে মৃত্যুমিছিল, সরকারি হিসেবে তা ৩৭৯। যদিও বেসরকারি মতে, সংখ্যাটা ১ হাজারেরও বেশি। ভারতে ইংরেজ শোষণের এক ঘিনঘিনে ছবি হয়ে আজও ফুটে উঠে রয়েছে জালিয়ানওয়ালাবাগ। কিন্তু দেড় হাজার মানুষের রক্তে স্নাত জঙ্গল ও পাহাড়ে ঘেরা মানগড়ের স্মৃতি যেন ঝাপসা হয়ে রয়েছে।
কেন? ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘প্রকৃত ভারতবর্ষের মধ্যে যে জীবনস্রোত বহিতেছিল, যে চেষ্টার তরঙ্গ উঠিতেছিল, যে সামাজিক পরিবর্তন ঘটিতেছিল, তাহার বিবরণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না।’ এই একটি বাক্যই যেন অমোঘ হয়ে ওঠে ভীলদের সেই মর্মস্পর্শী সংগ্রাম ও মৃত্যুগাথা প্রসঙ্গেও। আসলে আমাদের ইতিহাসে একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন রয়েছে। সেখানে আদিবাসী, অন্ত্যজদের সংগ্রাম বহু ক্ষেত্রেই আশ্চর্যজনক ভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আর তাই ১০৮ বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই গণহত্যা যেন লুকিয়েই রয়ে গিয়েছে পাহাড়ের কোলে। ঠিক যেমন ১৯২২ সালের গুজরাটে বিজয়নগরের কাছে বারোশো আদিবাসীর গণহত্যার কাহিনিও ইতিহাসের সন-তারিখের আড়ালে কোথায় চাপা পড়ে রয়েছে।
তবে আলো ক্রমে আসিতেছে। ১৯৯৯ সালে রাজস্থান সরকার মানগড়ে তৈরি করেছে শহিদ স্মারক। ২০১৩ সালে গুজরাট প্রশাসন গোবিন্দ গুরুর নাতি মান সিংকে সম্মান জ্ঞাপন করেছে। গত কয়েক বছর ধরে হাজার হাজার ৩১ জুলাই ভীল প্রতিনিধিদের জমায়েতও হয়। কিন্তু এই সব স্মারক ও স্মৃতিচারণের আয়োজন সত্ত্বেও ভারতের জনমানসে আজও ততটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারেনি একশো বছর আগের সেই ঘটনা। তবু মাঝে মাঝে ইতিহাসের পাতা উড়ে যায় ফড়ফড় করে। বিদ্যুচ্চমকের মতো ফিরে আসতে থাকে মানগড় গণহত্যা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.