নিজস্ব চিত্র।
সোমনাথ রায়, কার্গিল: “আই ওয়ান্ট টু সার্ভ দ্য নেশন।” দিদি জবা ভট্টাচার্যের বন্ধু তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, “বড় হয়ে কী হতে চাও?” বাড়িতে আসা অতিথিকে জবাবে এই কথাই বলেছিল বছর দশেকের পুঁচকে কণাদ, কণাদ ভট্টাচার্য। উত্তর কলকাতার টালার সেই ছোট্ট কণাদ কালের নিয়মে বড় হয়ে উঠে একদিন সেই স্বপ্ন পূরণও করে ফেলেন। যোগ দেন ভারতীয় সেনায়। তারপর থেকেই পাল্টে যায় জীবন। ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট, রাজ্যস্তরের সোনাজয়ী, সিএবি লিগে সুবার্বনের হয়ে ফার্স্ট ডিভিশন খেলা উইকেটকিপার, দুর্দান্ত তবলচি সেন্ট জেমসের ছাত্র হয়ে ওঠেন এক পুরোদস্তুর জেন্টলম্যান।
ছুটিতে কলকাতায় গিয়ে যখন বসতেন বন্ধুদের আড্ডায়, তখন তাঁর কথাবার্তায়, চলনে-বলনে বিস্তর অমিল খুঁজে পেতেন ছোট থেকে কণাদের পার্টনার ইন ক্রাইম অরিন্দম চৌধুরিরা। ব্রিজ, টোয়েন্টি নাইনের আসরে ছোটবেলার দুরন্ত, চঞ্চল অথচ ভীরু কণাদের বদলে পাওয়া যেত দায়িত্ববান, শৃঙ্খলাপরায়ণ, সাহসী, জেদি এক যুবককে। কণাদ ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, এর পুরোটাই ‘আর্মি এফেক্ট’। ছেলেবেলায় পুরনো সেই দিনের কথার র্যাপ সংস্করণ তৈরি করেছিলেন কণাদ। ’৯৮-এর পুজোর ছুটিতে শেষ যেবার বাড়ি যান, বন্ধুমহলে সেই গান শোনার আবদার ওঠায় কিছুতেই তা করেননি শহিদ লেফটেন্যান্ট কণাদ ভট্টাচার্য।
১৯৯৯ সালের ২১ মে কার্গিল যুদ্ধের সময় নিখোঁজ হয়ে যান কণাদ। টাইগার হিল পুনরুদ্ধারের পর যখন নিখোঁজ সহকর্মীদের খোঁজ চালাচ্ছিলেন জওয়ানরা, তখনই বরফের নিচ থেকে ১৫ জুলাই উদ্ধার হয় গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া নিথর দেহ। গোটা গায়ে মেলে ৩৪টি বুলেট। কণাদের বন্ধু অরিন্দম গল্প করছিলেন, “পুজোর ছুটিতে ফেরা ও কার্গিল যুদ্ধের মাঝে একবার শ্রীনগর থেকে ফোন করেছিল বাবু (কণাদের ডাকনাম)। বলেছিল ও নাকি ৩২টা গুলি করে এক সন্ত্রাসবাদীকে নিকেশ করেছে। অথচ ওকেই ঝাঁজরা হতে হল ৩৪টা গুলি খেয়ে।”
সেনায় যাবেন, ছোটবেলায় এমন স্বপ্ন দেখে এমন ভারতীয়র সংখ্যা বোধহয় খুবই কম। তবে বাকিদের থেকে কণাদের স্বপ্ন ছিল আলাদা। ওটাই ছিল কণাদের ( Kanad Bhattacharya) পাখির চোখ। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবথেকে ছোট ছিলেন কণাদ। কার্গিল বিজয়ের (Kargil Vijay Diwas) রজতজয়ন্তী উপলক্ষে অন্য শহিদ ও সৈনিকদের সম্মান দিচ্ছে ভারতীয় সেনা। দুই দিদি জবা ভট্টাচার্য এবং পূর্বা মুখোপাধ্যায় ভারতীয় সেনার আমন্ত্রণে এসেছেন কার্গিল। বৃহস্পতিবার দুপুরে দ্রাসের স্যান্ডো রিয়ার ক্যাম্পের অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান উপেন্দ্র দ্বিবেদীর হাত থেকে সেই সম্মান নেন জবা। তার আগে দ্রাসের লামোচেন ভিউ পয়েন্টের যুদ্ধ সংস্মরণ অনুষ্ঠানের পর দিদি পূর্বা মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, “আর্মিতে যাব, বীর হব, এসব বলত না ঠিক। কিন্তু মনে মনে ঠিকই করে রেখেছিল। এই নিয়ে কথা বলেও লাভ হত না। একদিন হঠাৎ বলল, ফর্ম ভরেছিল, পরীক্ষায় ডাক এসেছে।”
বড় স্ক্রিনে যখন ভাইয়ের বীরগাথা নিয়ে চলছিল অডিও-ভিজুয়াল, তখন চোখ মুছছিলেন দিদি জবা। ছোটবেলায় যে হাতে ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিতেন, সেই হাতেই এদিন নিতে হল ভাইয়ের মরণোত্তর সম্মান। জবা বলছিলেন, “২৫টা বছর কেটে গেল। এখনও ভাইটার কথা মনে পড়ে। বাড়িতে যখনই কোনও অনুষ্ঠান হয়, আনন্দের মূহূর্ত আসে, শুধু মনে হয়, ও থাকলে এই হত। এটা করত…” বলতে বলতেই ফের চোখ মুছতে থাকলেন জবা। যে কোনও শিশুর ছোট থেকে থাকে হাজার রকমের শখ। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যা পাল্টাতেও থাকে। সুনীল গাভাসকরের ভক্ত, তাঁর মতো ব্যাটার হতে চাইলেও কণাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল সেনার উর্দি গায়ে চাপিয়ে দেশমাতৃকার সেবা করা। সেই মায়ের কোলেই ২৫ বছর আগে চিরনিদ্রায় গিয়েছেন কণাদ। ভালবাসতেন বাংলা ব্যান্ডের গান। নচিকেতার জীবনমুখী গানই যেন ছিল একগাল স্মিত হাসি মুখে নিয়ে থাকা কণাদের লাইফলাইন। নচিকেতা লিখেছিলেন, ‘আমি ভবঘুরেই হব, এটাই আমার অ্যাম্বিশন…’। কণাদের জন্য নচিকেতা লাইনটা একটু বদলাতে পারতেন বৈকি! ‘…তবু আমি সেনাই হব, এটাই আমার…’।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.