লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে নানা কিসসা-কাহিনি পর্বে পর্বে সংবাদ প্রতিদিন ডট ইনে। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর ‘মৃত্যুরহস্য’ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর ‘জেলযাত্রা’, জ্যোতি বসুর ‘ঐতিহাসিক ভুল’ থেকে মোদির ‘রাজধর্ম পালন’- ফিরে দেখা হারানো সময়। লিখছেন বিশ্বদীপ দে।
আগের বার আমরা বোফর্স কেলেঙ্কারির কথা বলার সময় এসে পড়েছিল কার্গিল যুদ্ধের কথা। কেননা বোফর্স কামান ওই যুদ্ধে কেবল যে ব্যবহৃত হয়েছিল তাই নয়, তা যুদ্ধজয়ের অন্যতম হাতিয়ারও হয়ে উঠেছিল। এবারের লেখাও কার্গিল যুদ্ধ নিয়েই। কেননা এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আর এক কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গও। এমনিতে এই যুদ্ধ অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারকে বিপুল অক্সিজেন দিয়েছিল। কিন্তু সাফল্যের দীপ্তির আড়ালে থেকে গিয়েছিল অন্ধকারও। তারই নাম কফিনগেট। কফিন কেলেঙ্কারি।
১৯৯৯ সালের মে-জুলাই মাসে কাশ্মীরের কার্গিল যুদ্ধের (Kargil War) দিকে নজর ছিল গোটা দক্ষিণ এশিয়ার। সেই প্রথম এশীয় অঞ্চলের দূরদর্শনে দেখা গেল রুদ্ধশ্বাস যুদ্ধের চলচ্ছবি। ভারতীয় সেনার অসামান্য শৌর্যের ছটায় দেশবাসী গর্বিত হল। সেই সঙ্গে চোখের জলও ফেলল প্রায় পাঁচশো শহিদ সেনা কর্মী ও অফিসারদের শেষকৃত্যের দৃশ্য দেখে। অন্যবারের মতো প্রত্যেক শহিদের তেরঙ্গা বাঁধা কফিন পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল তাঁদের জনপদে। দাহ করার আগে সেগুলি রাখা হত এলাকার একেবারে কেন্দ্রে। যাতে শহিদ সেনানীকে শেষবারের মতো দেখতে পান সকলে। কেবল সংশ্লিষ্ট এলাকাই নয়, দূরদর্শনে সেই দৃশ্য দেখল গোটা দেশ। কিন্তু কে জানত, ওই কফিনগুলিকে ঘিরেই কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠবে!
আসলে দ্রুত নির্মিত কাঠের কফিন এই পরিস্থিতিতে ততটা কার্যকর হচ্ছিল না। তাই এক মার্কিন সংস্থা ”র কাছ থেকে ধাতব কফিন কেনা হয়। কিন্তু অচিরেই অভিযোগ উঠল, ওই কফিন কেনার সময়ই হয়েছে দুর্নীতি। ২০০১ সালের ক্যাগ রিপোর্টে প্রশ্ন তোলা হল, কেন আড়াই হাজার ডলার মূল্যে কফিনগুলি (Coffin Gate) কেনা হয়েছে? যেখানে আসল দাম এর মোটামুটি ১৩ ভাগের এক ভাগ! অর্থাৎ ১৭২ ডলারের আশপাশে। বিতর্ক তুঙ্গে উঠল।
একদিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী (Atal Bihari Vajpayee), অন্যদিকে সেই সময় দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজকে (George Fernandes) পড়তে হল নানা প্রশ্নের মুখে। হিসেব করে দেখা যায়, ওই কফিন কিনতে গিয়ে ১ লক্ষ ৮৭ হাজার ডলারের লোকসান হয়েছে সরকারের। এদিকে তদন্তে আরও উঠে এল মোট দেড়শোটি কফিন, যা প্রাথমিক ভাবে পাঠানো হয়, সেগুলোর ওজন ৫৫ কেজি করে। অথচ অর্ডার দেওয়ার সময় জানিয়ে দেওয়া হয় কফিনের ওজন যেন ১৮ কেজি হয়। এর পর বাতিল করে দেওয়া হয় চুক্তি। কিন্তু সরকার ৩ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫০০ ডলার আর উদ্ধার করতে পারেনি। বাতিল হওয়া কফিন নাকি পড়েছিল পরিত্যক্ত হয়ে। অন্যদিকে শহিদদের দেহ পৌঁছনো হয় কাঠের কফিনেই। সব মিলিয়ে কেলেঙ্কারির পরিমাণ ছিল প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার।
২০০৬ সালের জুলাই মাসে তদন্ত শুরু করল সিবিআই। কেন্দ্রে তখন মনমোহন সিং সরকার। প্রতারণা (ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০ নম্বর ধারা), অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র (ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০ বি নম্বর ধারা) নানা অভিযোগ তোলা হল সেখানে। অভিযুক্ত হন তিন আর্মি অফিসার। মেজর জেনারেল অরুণ রয়, কর্নেল এসকে মালিক ও কর্নেল এফবি সিং। অন্যদিকে মার্কিন সংস্থাটির হয়ে যিনি ওই কফিন সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন সেই ভিক্টর বাইজার নামও ছিল চার্জশিটে। এর চার বছর পরে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বিশেষ সিবিআই আদালত সমস্ত অভিযুক্তকেই অব্যাহতি দেয়। কেননা কারও বিরুদ্ধেই কোনও প্রমাণ মেলেনি। পরে ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর জর্জ ও বাজপেয়ীকে অভিযোগ থেকে মুক্ত করে সুপ্রিম কোর্ট।
কিন্তু নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে দেশভর শোরগোল পড়ে গিয়েছিল কফিন কেলেঙ্কারি নিয়ে। বিশেষ করে জর্জ ফার্নান্ডেজকে ঘিরে নিন্দার জড় বয়ে যায়। তাঁর কুশপুতুল দাহ করা হতে থাকে। যার বুকে লেখা ‘দ্য গ্রেট বিট্রেয়ার অফ ইন্ডিয়া’! এই সব ঘটনার অভিঘাত এমন ছিল, ইস্তফা দিয়েছিলেন জর্জ। যদিও পরে তিনি তা প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু এর পর ধীরে ধীরে তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারই অস্তমিত হয়। অনেক পরে যখন তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, তিনি শয্যাশায়ী। প্রবল অভিমানে বলেছিলেন, ”আমার কোনও ক্লিন চিটের প্রয়োজন নেই। অ্যালুমিনিয়াম কফিন কেনার বিষয়টা আমি প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন আমার টেবিল পর্যন্ত আসেইনি। আমাকে বরং একা একা শহিদের রক্তপান করতে দিন… কংগ্রেস তো সেরকমই বলে আমার সম্পর্কে।” তাঁর এমন মন্তব্য থেকে পরিষ্কার, কী ধরনের বিক্ষোভের মুখে সেই সময় পড়তে হয়েছিল তাঁকে।
১৯৮৯ সালের নভেম্বরে হওয়া লোকসভা নির্বাচনকে বলা হয়েছিল ‘বোফর্স ইলেকশন’। আসলে এই কেলেঙ্কারিকে হাতিয়ার বানানোর সব রকম সুযোগই নিয়েছিল বিরোধীরা। এবার সোনিয়া গান্ধী সুযোগ পেয়ে গেলেন। তাঁর স্বামীর নামে স্লোগান দিয়ে বলা হয়েছিল ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়’। এবার কংগ্রেস নেত্রী স্লোগান তুললেন, ‘কফিন চোর’! কুরসির কিসসায় এ আসলে এক স্বাভাবিক চলন। পরে বিচারে যা হবে, হবে। আপাতত সেটাকেই বিরোধীরা ‘অস্ত্র’ করে তোলে। যা অনায়াসে নড়িয়ে দিতে পারে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারও! জিপ কেলেঙ্কারি থেকে কফিন কেলেঙ্কারি, পরবর্তী সময়ের টুজি বা কমনওয়েলথ কেলেঙ্কারি- তালিকা নেহাত ছোট নয়। বার বারই কুরসিকে জোরালো ধাক্কা দিয়েছে নানা কেলেঙ্কারির তোপ!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.