Advertisement
Advertisement
Hyderabad

হায়দরাবাদের রাস্তায় রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিল রাজাকাররা! ফিরে দেখা ভারত কাঁপানো সেই দিনগুলি

সেই কালো দিনগুলি আজ ধূলিধূসরিত ইতিহাস।

Razakars: The Forgotten Massacre in Hyderabad
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:July 20, 2024 7:03 pm
  • Updated:July 20, 2024 7:03 pm  

বিশ্বদীপ দে: দেখতে দেখতে সিকি শতাব্দী পেরিয়ে এসেছে স্বাধীনতা (Independence Day)। তবুও অগ্রাহ্য করা যায় না ইতিহাসের গায়ে লেগে থাকা রক্তদাগকে। দেশভাগ যে চিরস্থায়ী ক্ষত রেখে গিয়েছে তাকে অস্বীকার করবে কে? কেবল দেশভাগই নয়, স্বাধীনতার পরই পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ। কিন্তু এরই সঙ্গে রয়েছে হায়দরাবাদের রাজনৈতিক অস্থিরতার ইতিহাসও। কাশ্মীরের ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া যত কথা শোনা যায়, সেই তুলনায় হায়দরাবাদের রাজাকারদের অত্যাচারের ইতিহাস আজ কিছুটা ধুলোয় ঢাকা। এই লেখায় ফিরে দেখা সেই ইতিহাস।

হায়দরাবাদ (Hyderabad) ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৪৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। আসলে এখানকার রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল তীব্র। ফলে সংঘর্ষ চরম আকার নেয়। রাজ্যের নিজামের প্রবল আপত্তি ছিল ভারতের অংশ হতে। শেষ পর্যন্ত ‘অপারেশন পোলো’ অর্থাৎ ভারতীয় সেনার সঙ্গে নিজামের পাক মদতপুষ্ট রাজাকার বাহিনীর লড়াই বাঁধে। তবে সেটা পরে। তার আগে রাজাকার বাহিনীকে চিনিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। তারও আগে ফিরে দেখা দরকার স্বাধীনতার অব্যবহিত আগের ও পরের পরিস্থিতি। আসলে ভারতে করদ রাজ্য তথা ‘প্রিন্সলি স্টেট’ ছিল ৫৬৫টি। তারা সেই অর্থে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তবে ব্রিটিশদের বৈদেশিক নীতি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কিছু শর্ত তাদের মানতে হত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তারা এই দেশের অংশ থাকবে কিনা সংশয় ছিল তা নিয়েই।

Advertisement

[আরও পড়ুন: অলিম্পিকে সম্ভাব্য পদকজয়ী: বক্সিংয়ে নিখাতকে নিয়ে আশায় দেশ]

জাতীয় কংগ্রেসের তরফে ১৯৪৭ সালের ১৫ জুন সমস্ত দেশীয় রাজ্যকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আবেদন জানাতে বলা হয়। দেশের স্বাধীনতা আসতে তখন আর ২ মাস বাকি। দেখা যায়, বহু রাজ্যই ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে সম্মত। পাশাপাশি এই প্রস্তাবে বাধ সেধেছিল বহু রাজ্যও। শেষপর্যন্ত দেখা যায়, তিনটি রাজ্যই ভারতের অংশ হতে চায় না। এই রাজ্যগুলি হল কাশ্মীর, জুনাগড় ও হায়দরাবাদ। কিন্তু কাশ্মীর ও জুনাগড় শেষপর্যন্ত ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলেও সবচেয়ে বড় ‘প্রিন্সলি স্টেট’ হায়দরাবাদ বাকি থেকে গিয়েছিল!

১৯৪৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার বর্ষপূর্তির পর হায়দরাবাদ দেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। আত্মসমর্পণ করেন নিজাম। কিন্তু তার ঠিক আগে লড়াইটা নিজামের সঙ্গে ভারতীয় সেনার হয়নি। তা আসলে হয়েছিল রাজাকারের সঙ্গে। সেই লড়াইয়ের আগে সেই রাজাকাররা কার্যতই নরসংহারে মেতে উঠেছিল।

[আরও পড়ুন: দেশের অর্থনীতির হাল কেমন! বাজেটের আগে আর্থিক সমীক্ষায় জানা যাবে ভাঁড়ারের হাল]

রাজকারদের সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আর একটু পিছিয়ে যেতে হবে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই হায়দরাবাদ ধীরে ধীরে ধর্মীয় কট্টরপন্থার দিকে এগোচ্ছিল। ১৯২৬ সালে স্থাপিত হল এমআইএম তথা মজলিশ-এ-ইত্তেহাদ-উল-মুসলিমিন। চলতি কথায় যারা পরিচিত ছিল ‘ইত্তেহাদ’ নামে। এই দলটি চাইছিল হায়দরাবাদকে মুসলিম রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করা হোক। ১৯৩৮ সালে এমআইএম নেতা বাহাদুর ইয়ার জং প্রতিষ্ঠা করলেন রাজাকার নামে এক আধা সেনা স্বেচ্ছাসেবী দল। ‘রাজাকার’ শব্দটি আরবি শব্দ। এর অর্থ ‘স্বয়ংসেবক’। মূলত পাঠান ও আরবরাই ছিল রাজাকার। ১৯৪৪ সালে মারা যান বাদাদুর। এর পরই ১৯৪৬ সালে রাজাকারের দায়িত্ব পান কাশিম রিজভি। বলা হয়, ক্ষমতায় তিনি প্রায় নিজামেরই সমকক্ষ ছিলেন। হায়দরাবাদ যেন কোনওভাবেই ভারতের অন্তর্ভুক্ত না হয়, সে বিষয়ে তিনি ছিলেন একবগ্গা মনোভাবাপন্ন। ফলে তাঁর নেতৃত্বে ইত্তেহাদ ক্রমেই হয়ে উঠেছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী চরমপন্থী। রাজাকাররা তখন সংখ্যায় নাকি ২ লক্ষ! তারা বলত ‘মাদার হায়দরাবাদ প্যায়দাবাদ’। অর্থাৎ ‘মা হায়দরাবাদ চিরজীবী হোক’।

মনে রাখতে হবে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত রাজাকারদের গতিবিধি ওই সাধারণ টহলদারি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এর পর তারা হয়ে ওঠে এমন এক সশস্ত্র বাহিনী যাদের কাজ নিজামকে রক্ষা করা। অনেকেই রাজাকারদের সঙ্গে মুসোলিনির ‘ব্ল্যাক শার্ট’দের তুলনা করেন। হিটলারের ‘স্টর্মট্রুপার’দের কথাও বলা হয়। ওই সব বাহিনীর মতোই রাজাকারও হয়ে উঠেছিল আতঙ্কের আর এক নাম। তারা চেয়েছিল হায়দরাবাদ পাকিস্তানের সঙ্গে মিশে যাক। কিন্তু ভৌগোলিক কারণেই সেটা হওয়া সম্ভবপর ছিল না। এমনকী সেই স্বাধীন রাজ্যটি স্বাধীন দেশে রূপান্তরিত হওয়াও সম্ভব হয়নি। প্রথমদিকে ব্রিটিশদের এতে সম্মতি থাকলেও পরে লর্ড মাউন্টব্যাটেন পরিষ্কার জানিয়ে দেন, এটা অসম্ভব। কেননা হায়দরাবাদের চারপাশে হিন্দু অধ্যুষিত রাজ্য। এবং হায়দরাবাদে কট্টরপন্থীদেরই প্রাধান্য। ফলে সাম্প্রদায়িক টেনশন ভয়ানক আকার নিতে পারে। এদিকে কাশিম তো একেবারেই চাইতেন না হায়দরাবাদ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হোক। এমনকী দিল্লিতে গিয়ে নাকি সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সঙ্গে বৈঠকও করেছিলেন। ভারত সরকারের চোখে তিনি অচিরেই হয়ে ওঠেন ‘নিজামের ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন-দানব’। দেশ স্বাধীন হতে না হতেই হায়দরাবাদ থেকে সংঘর্ষের খবর আসা শুরু হয়। কাশিমের নির্দেশে নির্বিচারে অত্যাচার শুরু করল রাজাকার বাহিনী। কেবল হিন্দুরাই যে তাদের টার্গেট ছিল তা নয়, মুসলিমরাও তাদের বিরোধিতা করলে তাঁদেরও ছেড়ে কথা বলা হত না।

এর পরই এল এক ভয়ংকর দিন। ২৭ আগস্ট, ১৯৪৮। ভৈরনপল্লি গ্রামে হামলা করল রাজাকারের দল। আজ সেই অঞ্চলটি তেলেঙ্গানায় অবস্থিত। একদিনের হামলায় প্রাণ গেল ৯৬ জন হিন্দুর (অন্য মতে সংখ্যাটা ১২০)। এর আগেও তারা এই গ্রামে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু স্থানীয়রা হাতের কাছে যা পেতেন, সে কুড়ুল হোক বা গুলতি তাই দিয়েই রুখে দিয়েছিল তাদের। কিন্তু এবার রাজাকার এল আরও বড় দল নিয়ে। তাদের সঙ্গে ছিল হায়দরাবাদের পুলিশ বাহিনীও। রক্তগঙ্গা বয়ে গেল সেই গ্রামে। গ্রামীণ মহিলাদের ধর্ষণ করা হল। অনেকে কুয়োয় লাফ দিয়ে প্রাণ দিলেন।

এমন নারকীয় ঘটনায় গোটা হায়দরাবাদেই রাজাকারদের প্রতি তীব্র বিক্ষোভের সঞ্চার করল। আর অচিরেই জন্ম নিল ‘অপারেশন পোলো’। সেপ্টেম্বরেই মেজর জেনারেল জে এন চৌধুরীর নেতৃত্বে ভারতীয় সেনা আক্রমণ করল রাজাকারদের। এমনকী সম্ভাব্য আকাশপথের হামলা সম্পর্কেও সতর্ক ছিল সেনা। কিন্তু লড়াই শুরু হতেই বোঝা গেল রাজাকাররা সাধারণ নিরীহ মানুষকে মারতে পারে। প্রশিক্ষিত ভারতীয় সেনার সঙ্গে লড়ার সাধ্য তাদের নেই। আর ‘বেচারি’দের সাধ ছিল পাকিস্তান বুঝি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু কোথায় কী? কেননা এর দুদিন আগেই মহম্মদ আলি জিন্নার মৃত্যু হয়েছে। ফলে মাত্র পাঁচদিনেই রাজকারদের জব্দ করে ফেলল। হায়দরাবাদ হল ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর কাশিম? তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি এদেশেই ছিলেন। অবশ্যই গারদের ওপারে। এর পর মাত্র দুদিনের মধ্যে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার শর্তে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। তিনি দেশ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজাকারদের কালো অধ্যায়ও যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল! তবে ইতিহাসের আসল শক্তি এটাই। কিছুই হারায় না। থেকে যায়।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement