বিশ্বদীপ দে: রাস্তাঘাট শুনশান। যেন কারফিউ। সবাই বন্দি টিভির সামনে। এমন দৃশ্য এই দেশ প্রথম দেখেছিল ১৯৮৭ সালে। রামানন্দ সাগরের ‘রামায়ণ’ সেবছরই প্রথম সম্প্রচারিত হয়েছিল। পর্দায় অরুণ গোভিল, দীপিকা চিকলিয়াদের দেখার জন্য উন্মুখ থাকতেন ভারতীয় দর্শকরা। সম্প্রতি অতিমারীর সময়ও সিরিয়ালটির পুনঃপ্রচার কতটা সাড়া ফেলেছিল নিশ্চয়ই মনে আছে। কিন্তু রামানন্দ সাগরের ওই অসামান্য সৃষ্টি কি কেবল এক সফল সিরিয়াল মাত্র? প্রায় সাড়ে তিন দশক আগের এক টিভি গাথা যে বদলে দিয়েছিল ভারতীয় রাজনীতির দিশাও! সেই প্রথম, এতটা শক্তিশালী ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছিল হিন্দুত্ব। যার পরিণাম ১৯৯০ সালে এল কে আডবাণীর রথযাত্রা। যা পরবর্তী মাত্র ৬ বছরের মধ্যে বিজেপিকে কেন্দ্রের ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিল। আর এই সবের মূলে ছিল ‘রামায়ণে’র তুমুল জনপ্রিয়তা।
রামানন্দ সাগরের সিরিয়াল কিন্তু বহু সমালোচককেই তুষ্ট করতে পারেনি। জি পি দেশপান্ডের মতো খ্যাতনামা নাট্যকার সংবাদমাধ্যমে সরাসরি লিখেছিলেন, ‘সাগরদের রামায়ণ নিয়ে খুব বেশি ভালো কিছু বলা মুশকিল। সীতা তো ভালো করে কাঁদতেই পারছে না!’ তাঁর মতো সমালোচকদের মতে, দূরদর্শনের অন্যতম সেরা হলেও আদপে এই সিরিয়াল যেন ‘ক্যালেন্ডার আর্টে’র বেশি কিছু হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু এই সব নান্দনিকতার খুঁটিনাটি বিচার সাধারণ দর্শককে মোটেই প্রভাবিত করেনি। তাঁরা রীতিমতো গণসম্মোহনে আবিষ্ট হয়ে পড়েন। পথেঘাটে রাম-সীতা-লক্ষণের চরিত্রাভিনেতাদের দেখলে যে হইহই শুরু হত তা রুপোলি পর্দার মহাতারকাদের দেখেও বুঝি হয় না!
একটা কথা এখানে বলে রাখা দরকার। রামানন্দ সাগর নিজেও ছিলেন একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ। কেমন রাজনীতি? ১৯৮৯ সালের ২৮ ও ২৯ আগস্ট ব্রিটেনে বাকিংহ্যামশায়ারের শহর মিল্টন কেইনসে আয়োজিত হয় ‘বিরাট হিন্দু সম্মেলন’। মূলত ব্রিটেনে বসবাসকারী গুজরাটি ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও আরএসএস সদস্যরাই ছিলেন এই সম্মেলনের পিছনে। সম্মেলনের অতিথিদের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং লতা মঙ্গেশকর। এবং ছিলেন রামানন্দ সাগর। মনে রাখতে হবে, এই সম্মেলনেই বলা হয়েছিল শাস্ত্র ও শস্ত্রের সহাবস্থানের কথা। দুই লেবার এমপির উপস্থিতিতে অযোধ্যায় রামমন্দির গড়ার প্রসঙ্গও উঠে আসে। সুতরাং সহজেই অনুমেয়, রামানন্দ সাগরের সমর্থনও সেদিকেই ছিল।
যাই হোক। হিন্দুত্ব সম্পর্কে সচেতন সাগর নির্মিত মহাকাব্যের টেলিনির্মাণের জনপ্রিয়তা ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে শুরু করে অচিরেই। মনে রাখতে হবে, কেবল আরএসএস-বিজেপিই নয়, কংগ্রেসও রামায়ণ ‘ম্যাজিকে’ প্রভাবিত হয়ে হিন্দুত্বের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। সেই সময় শাহ বানো মামলায় কিছুটা বেকায়দায় হাত শিবির। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ভয় পেলেন, এই বুঝি হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কে প্রভাব পড়ল! ‘পলিটিক্স আফটার টেলিভিশন: হিন্দু ন্যাশনালিজম অ্যান্ড দ্য রিশেপিং অফ দ্য ইন্ডিয়ান পাবলিক’ নামের এক গ্রন্থের লেখক অরবিন্দ রাজাগোপাল লিখেছিলেন, ‘মনে রাখতে হবে এই সিরিয়াল কিন্তু লঞ্চ করেছিল কংগ্রেসই। সেই কংগ্রেস যারা বাবরি মসজিদ নতুন করে খোলা নিয়ে প্রচার শুরু করেছিল। অরুণ গোভিল, যিনি রাম হয়েছিলেন সিরিয়ালে, তাঁর সঙ্গে পর্দার সীতা দীপিকা চিকলানিকেও উত্তরপ্রদেশের পুনর্নির্বাচনে কংগ্রেসের হয়ে প্রচারে নামানো হয়েছিল। ১৯৮৯ সালের ভোটপ্রচারে ভোটারদের কাছে রামরাজ্য গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। তবে এসবের থেকে যেটুকু ফলাফল কংগ্রেস পেয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়ে আসলে লাভবান হয়েছিল বিজেপি।’
১৯৮৯ সালে বিজেপির নির্বাচনী প্রচারের কেন্দ্রে ছিল অযোধ্যা। কিন্তু ১৯৯০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিং মণ্ডল কমিশন নিয়ে বিতর্কে জড়ালে গেরুয়া শিবির ভয় পেয়ে যায়। কেননা সেই সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল তারা। আর তাই নিজেদের দলীয় এজেন্ডা হিন্দুত্বের ফ্যাক্টরটিকে আরও মজবুত করে গড়ে তুলতে শুরু হয় অযোধ্যার দিকে রথযাত্রার পরিকল্পনা। যদিও প্রথমে আডবাণী ভেবেছিলেন পদযাত্রা করবেন। কিন্তু প্রমোদ মহাজন পরামর্শ দেন, পায়ে হেঁটে যাত্রা হলে তা হবে শ্লথগতির। দ্রুত এবং জোরালো প্রভাব ফেলতে পারা যাবে না। ফলে এবার আলোচনায় উঠে আসে মিনি ট্রাক। কিন্তু শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রথযাত্রার। আদ্যন্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ওই রথের সঙ্গে বিরাট সাদৃশ্য ছিল রামানন্দ সাগরের ‘রামায়ণে’র রথের! এমনও মনে করা হয়, সেই সময় আডবাণীকে দেখে অনেকের অরুণ গোভিলের কথা মনে পড়েছিল। যা দেখে পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ রীতিমতো আপ্লুত হয়ে তাঁকে প্রণাম করতে আসতেন। এমনকী, রথে পয়সাও ছুড়তেন।
এর পরের কথা সকলেরই জানা। আডবাণীর যাত্রা আটকে যায় বিহারে। ১৯৯০ সালের ২৩ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন ‘লৌহপুরুষ’। পরবর্তী সময়ে করসেবকদের তা ক্ষুব্ধ করে তোলে। বাবরি মসজিদের কাছে তাঁরা পৌঁছলে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদবের নির্দেশে পুলিশ গুলি চালায়। এর ধাক্কায় ভিপি সিং সরকারের উপর থেকে বিজেপি সমর্থন তুলে নিলে নভেম্বর মাসেই সরকার পড়ে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত এই যাত্রার সুফল পেয়েছিল পদ্ম শিবির। ১৯৯৬ সালে সরকার গড়েছিল বিজেপি। তার আগে ১৯৯২ সালের বাবরি ধ্বংসের কথাও এপ্রসঙ্গে এসে পড়ে। কিন্তু এই লেখার বিষয় তা নয়। সুতরাং রামানন্দ সাগরের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। যাঁর জনপ্রিয় সিরিয়াল রাতারাতি দেশের রাজনৈতিক চালচিত্রকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছিল।
ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহও লিখেছিলেন, রামানন্দ সাগরের টেলি গাথা রাম জন্মভূমি আন্দোলনকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করেছিল। অমৃতা শাহর লেখা ‘টেলি-গিলটাইনড: হাউ টেলিভিশন চেঞ্জড ইন্ডিয়া’ বইয়ে রয়েছে, কীভাবে প্রথমে ‘রামায়ণ’ ও পরে ‘মহাভারত’ টিভিতে দেখানোর সিদ্ধান্তে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন দূরদর্শনের কর্তারা। কেননা ‘সেকুলার’ ভারতে এভাবে দূরদর্শনের মতো মাধ্যমে হিন্দু মহাকাব্য দেখানো ঠিক কিনা, তাঁরা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তবুও তা দেখানো হয়। আর সেটা হয় বিজেপি আমলে নয়, কংগ্রেস জমানায়।
এমনও শোনা যায়, আসলে রাজীব গান্ধী মনে করতেন রামায়ণের ধর্মীয় দিকটির পাশাপাশি এর সাংস্কৃতিক দিকটিও অত্যন্ত শক্তিশালী। যদিও তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী বিঠ্ঠল রাও গদগিল ভিন্নমত পোষণ করে জানিয়েছিলেন, দূরদর্শনে মহাকাব্যের সম্প্রচার কেবল মাত্র বিজেপিকেই ফায়দা দেবে। তাঁর অনুমান যে ভুল ছিল না তা আজ বহুদিন হল পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। সেদিন অবশ্য বুঝতে পারেননি রাজীব। বুঝতে পারলে এবং অন্য কোনও সিদ্ধান্ত নিলে কি ভারতীয় রাজনীতির রূপ-রং অন্যদিকে বদলাত? এ নিয়ে কেবল আলোচনাই হতে পারে। ইতিহাস ‘যদি’, ‘কিন্তু’ নিয়ে আক্ষেপকে প্রশ্রয় দেয় না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.