সোমনাথ রায়, অযোধ্যা: সোমবার দুপুর থেকেই সরযূ নদীর ধারে ভিড় জমাচ্ছিলেন পুণ্যার্থীরা। অযোধ্যার পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে বাস, ম্যাটাডর করে এসে তাঁবু খাটিয়ে অনেকে রাত কাটিয়েছেন নদীর তীরেই। লক্ষ্য কার্তিক পূর্ণিমার কাকভোরে পুণ্যস্নান। অন্যবারের থেকে এবারের স্নানের একটা মৌলিক পার্থক্য ছিলই। ঐতিহাসিক রামমন্দির রায়ের পর এই প্রথম কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন স্থানীয়রা। এই পবিত্র দিনেই রামমন্দিরের জন্য গঠিত হতে চলা ট্রাস্টের সভাপতি হওয়ার জন্য যোগী আদিত্যনাথের নাম প্রস্তাব করল রাম জন্মভূমি ন্যাস (ট্রাস্ট)।
তবে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নয়, যোগীকে তারা সভাপতি হিসাবে চায় গোরক্ষপীঠের মোহন্ত হিসাবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরি করবে ন্যাসের তত্ত্বাবধানে তৈরি নতুন ট্রাস্ট। এদিনই আবার যোগীর সঙ্গে দেখা করতে যান শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের কয়েকজন নেতা। মসজিদের জমি-সহ আলোচনা হয় অন্য সামাজিক বিষয় নিয়েও। সেখানে উত্তরপ্রদেশ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব রাখা হয়, জমি এমন জায়গায় দেওয়া হোক, যেখানে মসজিদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ও তৈরি করা যায়। তবে এদিনই আবার বাঁকা সুরে কথা বলা শুরু করল রামমন্দির মামলার অন্যতম পক্ষ সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড। তাদের বক্তব্য, জমি দিতে হলে অধিগ্রহণ করা ৬৭ একরের মধ্যেই দিতে হবে। নয়তো দরকার নেই। তারা কিনে নেবে।
যোগীকে ট্রাস্টের সভাপতি করা প্রসঙ্গে মঙ্গলবার ন্যাসের চেয়ারম্যান মোহন্ত নৃত্যগোপাল দাস বলেন, “রামমন্দির আন্দোলনে গোরক্ষপীঠের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোহন্ত দিগ্বিজয় নাথ, মোহন্ত অভৈদ্ব নাথ ও বর্তমানে যোগী আদিত্যনাথের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই আমরা যোগীজিকে ট্রাস্টের সভাপতি হিসাবে চাই।” আদিত্যনাথ ছাড়া বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সভাপতি চম্পত রাই, কোষাধ্যক্ষ ওমপ্রকাশ সিংঘলরাও থাকতে পারেন বলে জানিয়েছে ন্যাসের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড মোহন্ত কমলনয়ন দাস। আরও বলেন, “মোহন্ত নৃত্যগোপালের তত্ত্বাবধানে কাজ করবে এই ট্রাস্ট।”
যোগীকে যখন ট্রাস্টের প্রধান করার ইচ্ছা প্রকাশ করল ন্যাস, প্রায় সেই সময়ই তাঁর সঙ্গে দেখা করেন মুসলিম নেতারা। রায় ঘোষণার পর রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা করেন তাঁরা। প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠকে লখনউয়ের দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা বা নাদওয়া কলেজের মৌলানা সলমন হুসেন নাদভি যোগীকে বলেন, মসজিদ তৈরির জন্য যেখানেই জমি দেওয়া হোক, সেখানে যেন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা যায় এটা মাথায় রেখে জমি নির্দিষ্ট করে উত্তরপ্রদেশ সরকার।
সেই সময়ই আরও একবার বিতর্ক খুঁচিয়ে দিল সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের ইকবাল আনসারি-সহ আরেক গোষ্ঠী। এদিন ইকবাল বলেন, “অনেকেই বলছে চোদ্দো ক্রোশের বাইরে গিয়ে মসজিদ তৈরি করো। আমাদের তা দরকার নেই। জমি দিতে হলে অধিগৃহীত ৬৭ একরেই দিতে হবে।” আনসারির বক্তব্য সমর্থন করেছেন স্থানীয় এক ধর্মগুরু মৌলানা জালাল আশরফ। তিনি বলেন, “আমাদের ভাবাবেগকে গুরুত্ব দিতে হলে ওই ৬৭ একরেই জমি দিতে হবে। নইলে জমি কেনার পয়সা আমাদের আছে। কারণ ১৮ শতকের সুফি সন্ত কাজি কাদওয়া-সহ অনেকের সমাধি ও দরগা আছে।” প্রায় একই ধরনের বক্তব্য পেশ করেন সর্বভারতীয় মিল্লি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক খলিল আহমেদ খান। বলেন, “আমাদের ললিপপ দরকার নেই। ওরা আগে স্পষ্ট করে বলুক জমি কোথায় দেবে, তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নেব।”
অযোধ্যা পুরসভার পুর প্রতিনিধি হাজি আসাদ আহমেদ ও অযোধ্যার জামিয়তে উলেমা হিন্দ সভাপতি মৌলানা বাদাহা খান জানিয়েছেন, “আমাদের লড়াই ছিল বাবরি মসজিদ নিয়ে। সেটাই যখন হয়নি, তখন অন্য মসজিদের কী দরকার? বরং ওই পাঁচ একরও রামমন্দিরকে দিয়ে দেওয়া হোক।” একই ধরনের কথা শোনা যায় এক স্থানীয় নেতা ইউসুফ খানের গলায়। তাঁর বক্তব্য, “মসজিদের দরকার প্রার্থনার জন্য। আর অযোধ্যায় অনেক মসজিদ আছে। কাজেই নতুনের কী দরকার? রায়ের পর এটা এখন ক্লোজড চ্যাপ্টার।”
রায় ঘোষণার পর থেকে সম্প্রীতির সুরে কথা বলেছে অযোধ্যা। একপক্ষের বেসুরো বক্তব্যে হঠাৎই কেমন যেন তাল কাটছে তাতে। যদিও বেশিরভাগের মুখে এখনও সাম্যের গান। দেখার শুধু কোনপথে গড়ায় অযোধ্যার ভবিষ্যৎ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.